১৫ ডিসেম্বর ২০১২

রাজীব চৌধুরী

মরা চোখ 
"মাগো- আমি আর পারিনা গো" বলেই মাটিতে বসে পড়ল মুন্নি। চোখে মুখে ব্যাথা স্পষ্ট হয়ে আছে। পা দুটো ধরে কাঁদতে শুরু করেছে। তার মত ১৪ বছরের মেয়ের জন্য এভাবে মাইলের পর মাইল পথ পারি দেয়া খুবই কষ্টের। সবে মাত্র যৌবনে পা দিয়েছে মুন্নি। কিন্তু এখন তাকে যেতেই হবে। কারন পেছনে হানাদার বাহিনী চলে এসেছে অনেক কাছে। মুন্নির দিকে তাকিয়ে সন্দীপ রায়ের চোখে মুখে স্পষ্ট ভয় প্রকাশ পেল।

"মা গো- আর একটু- আরেকটু পরেই আমরা পৌছে যাবো রে" বলেই হু হু করে কেঁদে ফেললেন সন্দীপ রায়। পেশায় স্কুল শিক্ষক। বয়স হয়ে গেছে দেখে উনি হাঁটতে পারছেন না। দু বছর আগে থেকে উনার বাতের ব্যাথাটা বেড়েছে। যৌবনে তিনি অনেক রাজনীতি করেছেন। কিন্তু এখন এসে আর পারেন না। কিন্তু এখন উনাকে পারতেই হবে। মেয়েকে সীমানার ওপারে আগরতলায় পাঠিয়ে তিনি ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে দুটোকে নিয়ে যাবেন।

"বাবা আমরা এখানে থেকে যেতে পারিনা? আমার প্রচন্ড খিদা পেয়েছে। কিছু একটা না খেলে আর আমি এগোতে পারবোনা "-চোখ দুটো ছল ছল করে তাকালো বাবার দিকে।সারি সারি লোক হাঁটছে। সবার উদ্দেশ্য যেকোন উপায়ে সকাল সবার আগেই পৌছাতে হবে বর্ডারে। সেখানে একবার যেতে পারলেই নাকি খাবার পানির অভাব হবেনা। কিন্তু এই সময়টা কিভাবে বাঁচবে সে চিন্তায় মানুষ গুলো ব্যাতিব্যাস্ত। কারো হাতে ছোট খাটো কিছু পোটলাতে খাবার ছিল। কিন্তু এখন মানুষকে দয়া দেখানোর সময় নয়। একজনকে দয়া দেখাতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার কোন মানে হয়না। এই চিন্তায় কেউ কাউকে সাহায্য করছেনা। বিশাল রাস্তায় একেবারেই একা হয়ে আছে সবাই। যে যার মত পালাতে চেষ্টা করছে। যারা যাচ্ছে সবাই প্রাণের মায়ায় ছেড়ে যাচ্ছে নিজের দেশ- নিজের জন্মভুমি। কিন্তু কেউ কাউকে সাহায্য করার চিন্তা ও করছেনা।

"মা রে- আর সামান্য দূরে। এর পরেই শুনেছি বর্ডার চলে আসবে" বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সন্দীপ রায়- বিখ্যাত সন্দীপ স্যার। চট্টগ্রামের রাউজান গ্রাম থেকে চলে এসেছেন একেবারেই আগরতলায়। তিনি যেতে চেয়েছিলেন পুরো পরিবার নিয়েই। কিন্তু এখন কোণ উপায় নেই। উনার দুই ছেলে সুদীপ আর প্রবীর মাত্র ক্লাস থ্রি তে পড়ে। ওদের এতোদুর হাটার মত সামর্থ নেই। তাই পঞ্চাশোর্ধ স্ত্রী সুতপার কাছে রেখে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। এককালে তিনি যাদেরকে পড়িয়েছেন তাদের রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে দেখে অনেক অবাক হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুই করার ছিলনা উনার। ছেলেগুলো তেড়া তেড়া কথা শুনিয়ে দেয় উনাকে। কাউকে বোঝাতে পারেননি তিনি। উলটো নিজের জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে গেছে। সবচাইতে বেশি সমস্যা তৈরি করেছে উনার পাশের বাড়ির তমিজ নামের ছেলেটা। ক্লাসে বার বার ফেইল করতো বলে বেশ বকা ঝকা করতেন সন্দীপ বাবু। কিন্তু সেই ছেলেই রাজাকার বাহিনীতে প্রথমে যোগদান করে। তারপরের দিনেই সন্দীপ বাবুর গোয়ালঘরে আগুন দেয় সে। কিন্তু সবচাইতে খারাপ অবস্থা হয় যখন সেই তমিজ আলাউদ্দিন শান্তিকমিটির রাউজান শাখার তমিজবাহিনীর প্রধান হিসেবে রাউজানে মিলিটারি বাহিনীকে সামনে থেকে পথ দেখানো শুরু করে। মিলিটারি গ্রামে আসার সাথে সাথে গ্রামের মেয়েদের আর মাঝবয়সী মহিলাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যেতে শুরু করে তমিজ বাহিনী নামে নতুন সৃষ্ট এই বাহিনী।সেই তমিজের নজর পড়ে মুন্নির উপর। এই খবর টা পাওয়ার পর থেকে ঘর ছেড়েছেন সন্দীপ বাবু। কিন্তু ঘর ছাড়লেও মন পড়ে আছে ঘরে দুটো দুধের শিশুর কাছে। ওরা উনার জন্য পথ চেয়ে আছে। হটাত করেই যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন সন্দীপ বাবু। আবার বাস্তবে ফিরে এলেন তিনি। কারন মেয়েটা উনার খিদেয় কষ্ট পাচ্ছে। উনার ও বেশ খিদে পেয়েছে। দুই দিন ধরে কিছু জোটেনি কপালে। একেবারে কাহিল অবস্থা। খিদে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা যায়।কিন্তু হাঁটতে গেলেই শরীর খাবার চায়। আর সেই খাবার নেই আশে পাশের কারোরই। যাদের আছে তারাও...।

“ভাই আমাকে দুটো বিস্কিট দিতে পারবেন?” মোটা সোটা এক লোক দৌড়াতে দৌড়াতে বেলা বিস্কিট খেয়ে যাচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল তার পোটলার ভেতর আরো অনেক কিছু আছে।

“ আরে না না- ভাই – সামনের ত্থোন সরেন। এখন সময় নাই। মিলিটারি পেছনে আইসা পড়ছে। এখন মনে হয় আমাগো ধইরাই ফালাইবো” বলেই ছুটলেন তিনি। পেছনে একবারো তাকালেন না। সন্দীপ বাবুর একটা কথা ও শুনলেন না।

ধীরে ধীরে ঘোলা চোখে আশেপাশে তাকাতে শুরু করলেন তিনি। উনারা যেখানে আছেন সেখানে দুইপাশে ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে কিছু ডোবার মত আছে। আর কিছু নেই। একেবারেই শুনশান এলাকা। এর মাঝে পিচঢালা রাস্তায় এগিয়ে চলেছে হাজারো মানুষ। ধীরে ধীরে আকাশে সুর্যের আলো দেখা দিতে শুরু করেছে। কিছু পাখি ডেকে চলেছে নতুন দিনের আগমনী জানাতে। এটা ছাড়া আশে পাশে আর কোন শব্দ নেই। খসখস শোনা যাচ্ছে শুধুই ধাবমান পায়ের শব্দ। এই নিরবতার মাঝে এটাই যেন বিশাল কোন শব্দ। খানিকটা আওয়াজ হলেই যেন একেবারেই হানাদার বাহিনীর মুখে পড়ে যাবে সবাই।

হটাত করেই কি মনে করে রাস্তা থেকে নামা শুরু করলেন সন্দীপ বাবু। বিশেষ কিছু একটার দিকে তিনি এগিয়ে চলেছেন। মেয়ে মুন্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে উনার দিকে। একটা পায়জামা পড়া ছিলেন তিনি। সেটা গুটিয়ে নেমে পড়লেন কাছের একটা ডোবায়। আর খানিক দূর গিয়ে সেখান থেকে তুলে আনেলন একটা শাপলা ফুল। সেটা থেকে পাতা গুলো ঝড়িয়ে নিয়ে ভাল মত ঝেড়ে ভেতর থেকে বের করে আনলেন সাদা সাদা কিছু বিচি। তারপর মুখে দিয়েই ঝাপ দিলেন যেন পানির ভেতর। আর দু হাত দিয়ে পনের বিশটা শাপলা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়লেন পানি থেকে।
কিন্তু তিনি বুঝতেই পারেননি তিনি কি ভুল করেছেন। উনার সাথে যারা সহযাত্রী ছিল সবার মাঝেই খিদে রাক্ষসের মত বিরাজ করছিল সেটা টের পাননি সন্দীপ বাবু। উনার হাত দশেক পেছনের থেকে কিছু চ্যাংড়া ছেলে উনার দিকে নজর রেখেছিল সেটা টের পাননি তিনি। আর উনার হাতে শাপলা ফুল গুলো দেখেই যেন ঝাপিয়ে পড়ল ওরা। মিনিট খানেকের মাঝেই শাপলা ফুল গুলো ছিনতাই হয়ে গেল সন্দীপ বাবুর হাত থেকে। পেছনে ফিরে দেখলেন সেখানে ঝাপিয়ে পড়েছে আর জন বিশেক বৃদ্ধ আর মহিলা। সবাই যে যার মত করে কাড়াকাড়ি করে খেয়ে চলেছে শাপলা ফুলের শ্বাস।

শেষে শুন্য হাতে ফিরে এলেন সন্দীপ বাবু। প্রথম যে ফুলটা তিনি ছিড়েছিলেন সেটাই অবশিষ্ট আছে উনার হাতে। আর কিছুই নেই। ফিরে এসে মেয়েকে ধরে কেঁদে ফেললেন তিনি। খিদের যন্ত্রনার চাইতে বড় যন্ত্রনা উনাদের পেছনে ধাওয়া করেছে। এখন পালাতেই হবে ভেবে দুইজনে আবার ছুটতে শুরু করলেন।

মুন্নির পা দুটো ফুলে উঠেছে ভয়ানক ভাবে। এর মাঝেই কিছুক্ষন বসে জিরিয়ে নেবার কারনে এখন কিছুটা হাঁটতে পারছে সে। কিন্তু সেটা কতক্ষন পারবে সেটা ভাবনার বিষয়। এর মাঝেই নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। হটাত করেই যেন সকাল হয়ে গেছে। এতক্ষন তাও আশপাশ থেকে লুকিয়ে পথ চলা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন পুরো ফকফকা। আর সকালবেলা মানেই মিলিটারির ভয়। একজন জানালো সামনে নাকি মিলিটারি ক্যাম্প করেছে। ওরা সবাই তাক করে আছে পথ চলা মানুষগুলোর উপর।

খবরটা শোনার পর থেকে পথ চলা মানুষগুলোর মাঝে নেমে এল শীতল আতংক। যাদের সাথে কিশোরী মেয়ে ছিল তারা যেন ভয়েই কুঁকড়ে আছে। সবার মাঝে টানটান উত্তেজনা। ভয়ে কেউ সামনে আগাতেই চাইছেনা। আবার কেউ পেছাতেও পারছেনা। ঠিক এমন সময় সামনে থেকে দ্রিম করে একটা শব্দ হল। আর শব্দ শুনে যে যেদিকে পারলো সেদিকে পালাতে শুরু করে দিল। সামনে কিসের শব্দ হচ্ছে সেদিকে না তাকিয়ে মুন্নি আর সন্দীপ বাবু। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারলেন না। তার আগেই ঠা-ঠা-ঠা করে গুলির শব্দ ভেসে এল। আর তার সাথে সাথে দু তিন জন ওমাগো বাবাগো বলে মাটিতে পড়ে গেল। সন্দীপ বাবু বুঝলেন সামনে পাক বাহিনীর শক্ত ঘাটি বসেছে। এখন উনাদের যে কোন মুল্যে এখান থেকে পালাতে হবে। শেষে নিরুপায় হয়ে পানিতে নেমে গেলেন দুইজনেই। কিন্তু পানিতে নামার আগেই দেখতে পেলেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে ঠা ঠা আওয়াজ। আর গাড়ির গর্জন। ভারী অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে চলে এসেছে পাকবাহিনী। পানিতে নেমেই প্রথমে ডূব দিলেন সন্দীপ বাবু। কিন্তু বেশি ক্ষন দম আটকে রাখতে পারলেন না তিনি। ঝপ করে উঠে পড়লেন। এদিকে মুন্নি পানিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ওর বাবার কান্ড। শেষে নিরুপায় হয়ে কিছুক্ষন আগে ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর ফেলে যাওয়া শাপলা ফুলের ডাটা তুলে নিল সে। তারপর সেটা নিয়েই ডুব দিল মুন্নি। মুন্নির দেখাদেখি সন্দীপ বাবুর মাথায় ও বুদ্ধিটা ভালই ঠেকল। তিনি একটা আধা খাওয়া ডাটা নিয়ে ডুব দিলেন পানিতে।

পানির খুব একটা গভীরে যেতে পারলেন না দুইজনের কেউই। তাই বাইরে থেকে ভেসে আসছে চিৎকার। মানুষের চিৎকার। বৃদ্ধের চিৎকার। শিশুর কান্না। সব মিলে মিশে একাকার। এর মাঝে একটা বিশেষ শব্দ চিনতে কোন কষ্ট হচ্ছেনা দুইজনের কারোই।সেটা হল বুলেটের শব্দ। মিলিটারিরা গুলি করতে করতে এগিয়ে চলেছে। যেদিক থেকে পারছে গুলি করে করে মারছে। তিন চারটা গাড়িতে করে এসে পড়েছে মিলিটারি।

যেখানে সন্দীপ বাবু আর মুন্নি লুকিয়ে ছিলেন সেখানেই কি মনে করে গাড়ির চাকা গুলো যেন থেমে গেল। ঝপাঝপ করে নেমে আসল ডজন খানেক মানুশ। সন্দীপ বাবু পানির নিচ থেকে শুনতে পারছেন সবকিছু। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজের দম আটকে শ্বাস নিয়ে চলেছেন। শেষ আশা- পাক বাহিনিরা কেউ বুঝতে পারবেনা উনারা এখানে লুকিয়ে আছেন।
“ইয়ে- ইধারমে এক আদমি অর এক আওরাত কো মেইনে দেখা- সার্চ করো- ও দোনো কিধার গেয়া” বলে কে যেন অর্ডার দিল। আর সাথে সাথে ঝপঝপ করে শব্দ শুরু হয়ে গেল। বেয়নেট দিয়ে খোঁচানোর শব্দ শুরু হয়েছে। পাক বাহিনীর সৈন্য গুলোর শকুন দৃষ্টি বাপ বেটির দিকে পড়েছে।
কিন্তু কিছুক্ষন খোঁচা খুচি করে ফিরে আসল সবাই। একজন বলল-

“স্যার- হামলোগ কুচ নেহি পায়া। ইধারমে কুচ নেহি হ্যা” – বলেই ইশারায় দেখিয়ে দিল ডোবার এক কোনায়। সেখানেই লুকিয়ে আছে সন্দীপ বাবু। আর সেখানে ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে পানি থেকে এক মুঠোয় তুলে আনল সন্দীপ বাবুকে। মুখে নল লাগানো। সেই নলের নাড়াচাড়া দেখে টের পেয়েছে ওরা। তারপরেই পানি থেকে উঠে দাড়াতে বাধ্য হল মুন্নি। কারন মুন্নির চুলের গোছা ধরে টেনে নিয়ে চলে দুই পাক সেনা।

“স্যার- ইয়ে মাল বহত খুব সুরত হ্যায়” বলেই ঠোট চাটল এক পাক সেনা।

“লো ইসে হামারা গাড়িমে ডালো অর ইয়ে আদমি কো উধার পৌছাদো” বলে আকাশে দেখিয়ে দিল কমান্ডার। আর সাথে সাথে একটা বেয়নেট ঢুকিয়ে দিল সন্দীপ বাবুর এক চোখ দিয়ে।চোখ দিয়ে ঢুকে সেটা মাথার পেছন দিয়ে  বেরিয়ে আসল বিশ্রী ভাবে। সন্দীপ বাবুর শরীর টা ধুকপুক করতে করতে হটাত করে থেমে গেল। উনার চোখ থেকে বেয়নেট টা বের করে নিয়ে পাকিস্থানি সৈন্য টা উর্দুতে বলল-

“সালা হারামি” বলে এক দলা থুথু ফেলল ভাল চোখটার উপর।

থুথুর দলাটা ঢেকে থাকায় দেখতে পেলেন না সন্দীপ বাবু তার মরা চোখ দিয়ে। নতুবা দেখতে পেতেন উনার মেয়েকে পাকবাহিনী তুলে নিয়েছে গাড়িতে।এখন পথ চলতে একটুও কষ্ট হবেনা তার। শুধু সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে কলংকের দাগ!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন