১৫ ডিসেম্বর ২০১২

কাসাফাদ্দৌজা নোমান

গল্প: একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার আত্নার কাল্পনিক কথা

বিশালাকায় কোন মানচিত্র নয়, ছোট্র একটি মানচিত্রের পিঠ চাপড়ে বললাম "তুই ভাল থাকিস।" সবুজ আর লালে উড়তে থাকা পতাকাকে বললাম "তুই আমার দেশ, তুই উড়িস মাকে নিয়ে" আমি চললামভয় পাসনে আমার গায়ে যে রক্ত দেখছিস সেটা রক্ত নয় ঘামএই ঘামের পরিশ্রমে মানচিত্র আর পতাকাকে উড়তে দিয়েছিএই ঘামের প্রতিটি বিন্দু হিসাব করাকেবল আমি নই লাখ লাখ মানুষ এই ঘাম ঝরিয়েছেএই ঘামের অবহেলারও হিসাব হবেহুমম এভাবেই বলতে বলতে চলে গিয়েছিলামআজ আবার ফিরে আসলামনা না জীবন্ত হয়ে না, আত্নার কিছু দ্বায় নিয়েআমি নিজেই জানিনা আমি কোথায় সমাহিত হয়েছিআদৌ কি সমাহিত হয়েছি কিনা? তবে এটা জানি আমার ধর্মের রীতি অনুযায়ী দাহ হয়ে ছিলামআমার হাঁড়ের অবশিষ্ট কোন টুকরো আছে কিনা সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত নাআমার নামইতো বিলীন হতে বসেছেবাংলাদেশের মানুষই যখন আমার ঘামের কথা ভুলতে বসেছে মাটিই বা কি করবে


কবিতা লেখার বড় বেশী শখ ছিলসময়ে পেলেই লিখতে বসে যেতামপরাধীন দেশে কবিতা লিখেও শান্তি নেইনিজের মত কিছুই করতে পারছিলাম নাকবিতাতো পরের কথা হাট বাজারে যেতেই ভয় পাচ্ছিলামপাকিস্থানীরা ওত পেতে আছেতার উপর আমি ছিলাম হিন্দুযুদ্ধ হবে বেশ বুঝতে পারছিলামকিন্তু নিজে গিয়ে যুদ্ধ করবো এতটুকু কখনই ভাবিনিবরাবরই আমি নিরীহ গো-বেচারা, ভীতু ছিলামপাড়ার রমেশের সাথে কথায় পারতাম না আর পাকিস্থানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো? অথচ কি অবাক করার মত কথা, আমি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি, শহীদ হয়েছিতারচে অবাক করার ব্যাপার হল আমাকে এবং আমাদের নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ বাজার বসিয়ে দিয়েছেকোন সেক্টরে ছিলাম ঠিক জানিনাছিল না কোন প্রশিক্ষনযুদ্ধটা আমি করতাম নাকবিতাতে মাঝে মাঝে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করা পর্যন্ত হয়ত থেমে থাকতকিন্তু সেদিন মাসির বাড়ী গিয়েছিলাম তাদের আমাদের বাড়ী নিয়ে আসতেতাদের ওইদিকে পাকিস্থানীদের উৎপাৎ বেশীমা কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন নামাসি আমার এক ধাপ এগিয়ে, তিনি কিছুতেই আসবেন নামাসী ছাড়া বাড়ী এসে দেখি দাউ দাউ করে জ্বলছে আমার বাড়ী, গ্রামআমার মা,বোন,দাদা কাউকে জীবিত পেলাম না, এমনকি মৃতও নাবাবা মারা গেছেন বছরখানেক আগেআমার সেদিনকার অনুভুতি বুঝাতে পারবো নানিরীহ আমার আর কোন অবলম্বন নেইগ্রামে থাকা নিরাপদ না, কাছের মানুষদের কথা ভুলে গিয়ে চলে গেলাম অজানার উদ্দেশ্যেভীড়ে গেলাম গেরিলানামক একটি দলেঅস্ত্র চালাতে পারতাম নাআসলে কবিতা লেখা ছাড়া কিছুই করতে পারতাম নাআমাদের দলনেতা ছিলেন রুবেল ভাইঅদ্ভুত বলিষ্ঠ এই লোক যেমন অস্ত্র চালাতেন তেমন সুন্দর গানও গাইতেনপ্রায় তিনি আমাকে বলতেন সতীশ আজ কি কোন কবিতা লিখেছিস? একটা শোনাতো দেখিআমি মহা আগ্রহে শোনাতামযোদ্ধাকে একটু শান্তি দেয়াই ছিল আমার এক প্রকার যুদ্ধ

যোদ্ধাদের দলে ঢুকে আমিও যোদ্ধা হয়ে গেলামমনে পড়ে যেদিন প্রথম ষ্ট্যনগান হাতে নিই হাত কাঁপছিল ভীষন এত ভারী একটা জিনিস কিভাবে বয়ে বেড়ায়? আমারতো দুমিনিটে হাত ব্যাথা হয়ে গেছেআমার সকল প্রশ্নের উত্তর দেশপ্রেমযেখানে সবাই প্রাণ দিতে প্রস্তুত সেখানে বয়ে বেড়ানোটাই সামান্যএরপর কিন্তু আমি কাঁধে ষ্ট্যানগান বয়ে বেড়িয়েছিআমার হাতে খুন হয়েছে গোটা পাঁচেক পাকিস্থানী আর্মি এবং পুরো আর্মির একটি ক্যাম্পসেখানেও ২৫-২০ জন আর্মি ছিল



আমি আপনাদের আমার কোন অপারেশনের কথা বর্ণণা করবো নাসেটা কম বেশী আপনারা সবাই জানেনআমি শুধু আমার নিজের কিছু কথা জানাবোবাবা ছিলনা, বোনটিও প্রায়শ অসুস্থ থাকতোমাকে তাই রান্নায় সাহায্য করতে হতসেখান থেকে রান্নাটা শিখে গিয়েছিলামআমার মূল কাজ ছিল রান্না করাআমাদের দলে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলবুদ্ধিতে, সাহসে, অস্ত্র চালানোতে আমিই সবচেয়ে দুর্বল ছিলামতাই রান্নার কাজে আমি বেশ যোগ্য ছিলামমাঝে মাঝে ক্লান্ত সবাইকে দুএকটা কবিতা শুনাতামতারা বেশ মজা পেতএটাই আমার ভাল লাগতআমি গেরিলা দলে মিশে যাই এপ্রিলের মাঝামাঝিএপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রতিবেলা আমি রান্না করেছিএপ্রিলে আমরা ১৭জনের রান্না করতাম ,জুলাইয়ে এসে ১৪জনের খাবার রান্না করতে হতএরপর আমি চলে যাবার পর তারা ১৩ হয়ে গিয়েছিলজানিনা তারা কিভাবে রান্না করেছিল নাকি আরও চলে গিয়েছে নাকিআমি যেদিন চলে যাব সেদিন সকাল থেকে এক ধরনের অস্থিরতা ছিলআমরা বুঝতে পারছিলামনা আমরা জিতবো কি হারবোপতাকা উড়ানোর জন্য মনে মনে ঠিকই প্রস্তুতি নিচ্ছিলামআমাদের খুব কাছেই পাকিস্থানী আর্মি ক্যাম্প বসিয়েছিলসবাই বসে প্ল্যান করছিল কিভাবে আর্মির ক্যাম্পে হামলা চালানো যায়সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হল আত্নঘাতি হামলা করা হবেকিন্তু কে যাবে শরীরে গ্রেনেড বেঁধে? সবাই রাজিআমি সবাইকে বুঝালাম আমি অপেক্ষাকৃত দুর্বল অন্যদের একজন গেলে আমাদের শক্তি কমে যাবে, আমি গেলে ক্ষতিটা কম হবেআমার যুক্তি নিয়ে আলোচনা হলশেষে সিদ্ধান্ত নিল আমিই যাবমরে যাব ভেবে একটু খারাপ লাগছিল তবে আনন্দটা বেশী লাগছিলআমি যদি আমার কাজে সফল হই আমার একজনের বিনিময়ে আমরা বিশজনকে ধ্বংস করতে পারবকিন্তু আমার থেকে আমার দলের অন্যদের মন বেশী খারাপ ছিলকি যেন একটা বাঁধনে জড়িয়ে গিয়েছিলামজানি সবাইকে আর পাবনা, নিজেকেও পাবনা, বিকেলে দীঘির জলের ছায়া কবিতাও লিখা হবে না, মাধবী নামক যে মেয়েটিকে মনে মনে চাইতাম তাকেও পাব নাকিন্তু এটা জানি একটা দেশ পাব,মানচিত্র পাব আর পাব একটি উড়ন্ত পতাকাপ্ল্যান যতটা সহজ ছিল আর্মি ক্যাম্পে প্রবেশ করা অত সহজ ছিল নাকিন্তু আমি পেরেছিলামউড়ে গিয়েছিল পুরো আর্মি ক্যাম্পএরপর আমি আর কিছুই জানিনা



বেঁচে থাকলে কি করতাম জানিনাশুনেছি আমাদেরকে নিয়ে নাকি রমরমা ব্যবসা হচ্ছেসার্টিফিকেট দিয়েও চিন্হিত করার চেষ্টা করা হচ্ছেশুনে খুব লজ্জা পেয়েছিএতটা যদি ওসময় চিন্তা করা যেত তবে আমাদের স্বাধীন হওয়া কখনই হত নাআমার আত্নার ডাকেই হাড়গোড় বিহীন আমি মাঝে মাঝে জেগে উঠিজেগে উঠি পল্টন ময়দানের মিথ্যাচারেবেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুব আফসোস হয়, বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা হয়ত শহীদ না হওয়াতে আফসোস করছেনএই আফসোস মনে হয় সারাজীবন চলতে থাকবেকখনই ভাবিনি আমাদের এত বড় অর্জন একসময় আফসোসের কারন হবেরাজনীতিবিধ নামক কিছু প্রাণী পুরো দেশটাকে ধীরে ধীরে হজম করে নিচ্ছেস্বাধীনতা, মানুষের সবরকম চাহিদা একে একে কেড়ে নিচ্ছেদেশের মানুষের মনে একধরনের মানষিক যুদ্ধ চলছেখুব বেশীদিন হয়ত নেই আরেকটি যুদ্ধের৭১য়েও আমরা বহুদিন মানষিক যুদ্ধ করেছি, পাকিস্তানীদের সহ্য করেছি৭১ ফিরে নিশ্চয় আসবেসেদিনের অপেক্ষায় মৃত শরীরে আমার জীবিত আত্না



(
এটি একটি কাল্পনিক গল্প, শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা কখনই জানবেন না বর্তমান বাংলাদেশে কি হচ্ছে, কত নোংরাভাবে আমরা তাদের দানের পতাকাকে, মানচিত্রকে অবহেলা করছিআমার এই গল্প শহীদ হওয়া এবং বেঁচে থাকা সব মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করলামআমরা আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থীআমরা আসলেই কখনই বুঝবো না কতটা আত্নত্যাগ স্বীকার করেছেন আপনারা)

মুক্তযুদ্ধের কাল্পনিক গল্প লেখা বিরাট সাহসের ব্যাপারকল্পনা থেকে অনেক বেশী কিছু হয়েছিলভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী

1 টি মন্তব্য: