৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২

সরদার ফারুক

 অনুরাধা টেইলারিং হাউজ

এই গলিটার পাশেই ছিল অনুরাধা টেইলারিং হাউজ । প্রকাণ্ড শিরিষ গাছের নিচে লম্বা একটা ঘর । অনেকগুলো সেলাই মেশিনে ঘরঘর শব্দ তুলে নানা বয়সের কারিগর কাজ করে যেত ।ছেলেছোকড়ারা নিচে বসে বোতাম লাগাতো ,ব্লাউজের হুক লাগাতো ।দোকানের পেছনেই কর্মীদের থাকার জন্য এক সারি ঘর ।

অনেকদিন আগে এখানেই আমি দর্জির কাজ শিখতাম ।এতিমখানার শিশুসদনে ক্লাস এইটে আমার রেজাল্ট দেখে সুপার আপা বললেন -“ তোর হবে না , এবার কিছু একটা হাতের কাজ শিখে নে।”
আমরা যারা শিক্ষানবীশ , বেতন-টেতন তেমন কিছু পেতাম না , মাঝে মধ্যে দশ-বিশ টাকা হাতখরচ আর দু’বেলা খাবার ।অনেকটার পেটে-ভাতেই বলা যায় , ভাত মানে মোটা চালের ভাত ।বাজারে যখন যে সবজিটা শস্তা , সেই সবজিটার একরকমের লাবড়া বানানো হতো ।সাথে থাকতো রঙহীন পাতলা ডাল , আমরা বলতাম -কানার চোখের জল ।
হয়তো কিছুদিন একটানা পেপের লাবড়া চলছে , তারপর শুরু হতো পাতাকপির ঝোল । ভাগ্য ভালো হলে কখনো কখনো ঈদের চাঁদের মতো নলামাছের পাতলা একটা টুকরো পাতে পড়তো । সেদিনটা খুব আনন্দের দিন ।


আমি আর রতন একই খুপরিতে থাকতাম ।বাঁশের বেড়া , মাটির মেঝে , একটা ছোট জানালা ।কুমিল্লার কোন এক গ্রামে ছিল রতনদের বাড়ি ।ওর একটা দোষ ছিল কথায় কথায় মুখ খারাপ করা ।

বশির ওস্তাদ ছিল আমাদের দুঃসময়ের সবচে’ বড় ভরসা । অবাঙালি , ইউপি না বিহার কোথায় যেন বাড়ি , দাঙ্গার সময় পালিয়ে এসেছে । মাথায় ঢেউ খেলানো চুল , চোখে সুর্মা টানা - সবসময় সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবী পরে থাকতো ।ওস্তাদের একটা অভ্যাস ছিল , প্রায় সারাক্ষণই গুনগুন করে গজল গাইতো - আমরা অবশ্য কথাগুলো কিছুই বুঝতাম না ।

কাজের সময় খুব দরদ দিয়ে কাজ শেখাতো । কখনো কখনো দু’য়েকটা চড়-চাপড় যে মারতো না , তা ঠিক না - তবে বেশিরভাগ সময় খুব দুঃখী গলায় বলতো - “ এইটা কি অসুরের কাম ভাবছো , এইটা আর্টিস্টের কাম ।”
অথবা - “চুড়িদার পায়জামার কাম এত সোজা ভাবলা , কুঁচিগুলা ভালো কইরা খেয়াল করো।”

ওস্তাদ বিয়ে করেছে কি না ,করে থাকলে বৌ-বাচ্চা কোথায় - আমরা তার কিছুই জানতাম না ।কেউ কেউ বলতো দাঙ্গায় সবাই মারা গেছে ।ওস্তাদ অবশ্য এসব ব্যাপারে কারো কোনো প্রশ্নের জবাব দিত না ।

আমরা ববিনে সুতো ভরতে ভরতে , জামার কলারের বক্রম কাটতে কাটতে অদ্ভুত সুরের গুঞ্জন শুনতাম - ‘ দুখ অব ফিরাক কা হমসে সহা নহীঁ জাতা
ফির উসসে জুলম এহ হ্যায় কুছ কহা নহীঁ জাতা । ’


কখনো কখনো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতাম , ঘোর সবুজ জিগনি গাছে একটা সবুজ টিয়া পাখি এসে বসেছে ।

মাঝে মাঝে বশির ওস্তাদ খুব সেজেগুজে ,আতর মেখে কোথায় যেন যেতো ।লোকজন বলাবলি করতো ওস্তাদ খারাপ পাড়ায় যায় , ওখানে তার একজন মহব্বতের মেয়েমানুষ আছে ।কেউ অবশ্য হলফ করে বলতে পারতো না যে , সে নিজের চোখে দেখেছে । তবে আমরা তাকে গভীর রাতে পুকুরের পাড়ে বসে পান করতে দেখেছি ।

কাজের শেষে নিজের ঘরে একটা খাতায় উর্দু ভাষায় কী যেন লিখতো । খাতার ওপরে অবশ্য বাংলায় লেখা ছিল - কায়েস মীর ।একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম , এটা কার নাম ।
মুচকি হেসে বলেছিল ,“ ব্যাটা তাখাল্লুস বুঝিস ? ”
আমি হা করে তাকিয়ে থাকায় নিজেই বুঝিয়ে দিলো - তাখাল্লুস হচ্ছে উর্দু কবিদের ছদ্মনাম । আরবের প্রাচীন কবি ইমরুল কায়েস আর ওস্তাদের সবচে’ প্রিয় কবি মীর তকী মীরের নাম মিলিয়ে নিজের নাম রেখেছে ।
তবে শত অনুরোধেও নিজের লেখা শের কখনো শোনাতো না । বলতো-“ আমার তো কিছুই হয় না ব্যাটা ! শুনবিই যদি মীরের একটা শের শোন ।”

তারপর মায়াবী গলায় বলে যেতো -

কুছ খুব নহী ইতনা সতানা ভী কিসিকা
হায় মীর ফকির , উসকো নহ্ আজাব দিয়া কর ।

নিজেই তর্জমা করে দিতো-

এমন করে কাউকে যন্ত্রনা দেয়া কি ঠিক?
মীর তো এমনিতেই সর্বহারা , তাকে আর কষ্ট দিও না ।



এ সময়ে ওস্তাদের চোখের কোণ চিকচিক করতো ।


অনেক অনেক দিন হ’ল আমি এই শহর ছেড়ে গেছি । দোকানের মালিক মানিক সাহা ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়ার পরে এখানে একটা প্লাস্টিকের কারখানা হয়েছে ।কে কোথায় ছিটকে পড়েছে জানি না । রতন বা ওস্তাদ কারো কোন খবর জানি না ।আমিও নানা ঘাটে ঠোকর খেয়ে খেয়ে থিতু হতে পারিনি । নারিন্দায় একটা বাড়ির কেয়ারটেকারের চাকরী থেকে শুরু করে মগবাজারের হোটেল দিলদারে মেয়েমানুষের দালালি - সবকিছু করেছি ।

তবু অনুরাধা টেইলারিং হাউজের কথা হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় ।আজ কী ভেবে অনেক কাল পরে এখানে চলেও এসেছি ।খুব ইচ্ছে করছিল বশির ওস্তাদের কণ্ঠে মীর তকীর একটা শের শুনি ।

২টি মন্তব্য: