৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২

রাজীব চৌধুরী

ইকারাসের সমুদ্র পতন

আমার পরিবারের পুরুষ দের মাথায় কিঞ্চিত ছিট আছে। বেশির ভাগই ছিলেন ভ্রমণ প্রিয়- এডভেঞ্চার প্রিয়। উড়ূ ঊড়ু মনের মানুষ গুলোর অনেকেই জীবনের বিশাল একটা সময় কাটিয়ে দিয়েছেন ঘুরতে ঘুরতে।যেমন আমার দাদির মুখে শুনেছি আম
ার দাদা ছিলেন বিশাল জমিদার। কিন্তু কি এক নেশায় তিনি চলে যান বার্মায়। সেখান থেকে আর ফেরেন নি তিনি। কেউ এখনো জানেনা উনার কিভাবে মৃত্যু হয়েছে- কোথায় দাফন হয়েছে। আমার দাদুর বাবা ও ছিলেন জমিদার। তিনি জন্ম সুত্রে জমিদারি পেয়েছিলেন। সেই আমলে তিনি প্রায়শই সাধারণ বনিক দের সাথে খামোখাই যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে যেতেন। আবার উনার ছিল শিকারের নেশা। সেই একবার এক বাঘ শিকার করতে গেছিলেন সমতট জংগলে। আর ফিরে আসেন নি তিনি। তাঁর আগের লোকজন দের কথা আমি জানিনা। তবে শুনেছি সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমল থেকে আমাদের পরিবার এই বঙ্গ তথা বাংলাদেশে।সেই সময় সাহসিকতার জন্য আমাদের পরিবার কে দেয়া হয়েছিল চৌধুরী উপাধি। আরেকটা উপাধি ও আছে। সেটা হল ছিট পরিবার। আমাদের পরিবারের সব পুরুষের মাথায় সামান্য পরিমান ছিট থাকার কারনে এই উপাধি দিয়েছে আমাদের পরিবারের ই নারী কুল।


আমার বাবা যদিও বেশ কিছুদিন ছিলেন এই সংসারে। কারন উনি শখ করেই মুক্তিযুদ্ধে গেছিলেন সেই কিশোর বেলায়। বয়স তখন মাত্র ১৩। ছোট ছিলেন বলে বাবাকে গ্রেনেড আর গুলি বহন করতে দেয়া হয়েছিল রেজিমেন্টে। আর সেখানে বিভিন্ন সমর যুদ্ধে অংশ নেবার পর একদিন উনি পাক বাহিনীর গুলি খেয়ে প্রায় পঙ্গু হয়েছিলেন। সেই আমলে বাবার পায়ের ভেতর ঢোকানো হয়েছিল লোহার শলাকা। সেটা দিয়ে কোন রকমে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটা আমার বাবাকে এখন দেখলেই মনে হয় উনি বেশ আশাহত এর পর কোন অভিজানে বের হতে না পেরে।তবে এখন যাকে নিয়ে কথা বলব তিনি আমার ছোট চাচা।

ছোট চাচা মাত্র কয়েকদিন হল বাসায় এসেছেন। এর আগ পর্যন্ত আমি জানতাম ই না যে আমার কোন চাচা আছে। বাড়িতে কোন ছবি ও ছিলনা উনার। আমি মনে ই করছিলাম যে আমার বাবা একজন সন্তান আমার দাদার। কিন্তু উনি হটাত করে একদিন শরীরে বিশাল এক ব্যাগ ঝুলিয়ে কোথেকে যেন হাজির হলেন। আমি প্রথমে ঢুকতে দিতে চাইনি ঘরের ভেতর। পরে কি মনে করে বললাম- আসুন। কারন আমি আমার বাবার থুতনির সাথে লোকটার থুতনির মিল পাচ্ছিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল উনি আমার খুব পরিচিত কেউ হবেন। এরপর মা আসলেন। কিন্তু তিনি চিন্তে পারলেন না চাচাকে। বসিয়ে রাখলেন ড্রয়িং রুমে।

চাচা সেখানে বসে বসে আমাদের পারিবারিক ছবি গুলো দেখছিলেন। আমাদের বাসায় আবার ছবি টাঙ্গানোর বাতিক আছে। আমার বাবা- দাদা- তাঁর বাবা- তাঁর বাবা- সবার ছবি আছে। তবে আমি গুনে দেখেছি মাত্র বারো টা ছবি আছে। তার মানে হয় এর মাঝে আগে পিছে র লোকদের ছবি পাওয়া যায়নি কিংবা খুঁজে পাওয়া যায় নি। নতুবা এর আগে আমাদের বংশটাই ছিলনা।

যাই হোক এমন সময় স্ট্রেচার এ ভর দিয়ে বাবা হেঁটে এলেন হল ঘরে। উনি এসেই চিৎকার চেঁচামেচি। আমি আর মা দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি বাবা কাঁদছেন। কাঁদছেন সেই মানুষটি ও । পরেই জানতে পারলাম সেই চৌদ্দ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া আমার ছোট চাচা ফিরে এসেছেন আমাদের ঠিকানায়। সেদিন আমার শয্যাশায়ী দাদীর মুখ থেকে আমি সেই ছোট বেলার মত গল্প শুনেছিলাম। নিজের ছেলেকে ফিরে পেয়ে তিনি যেন আকাশের চাঁদ ফিরে পেয়েছিলেন। অবশ্য আমাদের পুরো পরিবার ছিল সেই শ্রোতা তালিকায়। দাদি অনেক বছর পর আমাদের ছিট গ্রস্থ পরিবারের পুরুষদের কাহিনী বললেন। বললেন কিভাবে আমার দাদা হারিয়ে গিয়েছিলেন বার্মায়। যদি ও আমরা সবাই জানি দাদী ছিলেন না সেই সব অভিজানে। কিন্তু আমাদের শুনতে বেশ লাগছিল।

কিন্তু আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল যখন শুনলাম আমার চাচা চলে যাবেন এর পর দিন ই। আমি তো প্রায় কান্না জুড়ে দিলাম। আমার ছোট কেউ নেই দেখে আমি পনের বছর বয়সেও কান্না করতে পারি। আবদার করতে পারি। তবে আমি ও মাঝে মাঝে তাগিদ অনুভব করি। মনে মনে কে যেন আমাকে বলে –“পালাও-পালাও” কিন্তু কই পালাব সেটাই ভেবে পাইনা। আর যখন ভেবে পাইনা আমি তখন ছবি আঁকা শুরু করি। আঁকতে আঁকতে আমার হাত বেশ পটু হয়ে গেছে। ছোট চাচা আমাকে যখন ই বললেন উনি চলে যাবেন সাথে সাথে আমি উনার ছবি আঁকতে বসে গেলাম। উনাকে সামনে রেখে আলো ছায়ার খেলা দিয়েই একে ফেললাম একটা পোট্রেট।

এরপর রাতের বেলা সবাই মিলে আলোচনায় বসলাম। আলোচনার মধ্যমনি আমার দাদী। তিনি বিছানা ছেড়ে এসে সোফায় বসে বসে শাসালেন চাচাকে। কিন্তু কোন লাভ হলনা। মা কাঁদলেন অনেক দিন পর। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি গোঙ্গালাম। ফুফু চিৎকার করে ভাইয়ের জন্য বিলাপ করলেন। কিন্তু চাচাকে ফেরানো গেলনা। সেদিন রাতেই তিনি চলে গেলেন। তবে যাবার আগে আমাকে একটা উপহার দিলেন। উপহার ছিল একটা সোণার কলম আর একটা ডায়েরি।

সেদিক আমি উপহার গুলো ছুঁয়ে ও দেখিনি। বাসা থেকে চাচা চলে যাবার পর আমাদের বাসাটা আবার আগের মত হয়ে গেল। সেই নিয়ম করে সকালের নাস্তা- স্কুল- দুপুরের খাবার- বিকেলের বোরিং টিভি দেখা। রাতের পড়াশোনা আর খাবার খেয়ে ঘুম। এই করতে করতে আমি যখন প্রায় হাফ ধরা পাখির মত তখন ই আমার মনে পড়ল ডায়েরিটার কথা। বিশ্বাস করুন- আমার ডায়েরি পড়তে একদম ইচ্ছা করেনা। আমি লিখতে পারিনা। আর পড়তে পারিনা। বাবা অনেক বই পড়েন। নিচের হল ওয়েতে বিশাল একটা লাইব্রেরি আছে। আমি সেখান থেকে একটা বই ও ছুঁয়ে দেখিনি।

ডায়েরিটা খুলেই দেখি পৃষ্টা ফাঁকা। আমি বেশ কিছু ফাঁকা পৃষ্টার পর লেখা খুঁজে পেলাম মাঝামাঝি বরাবর। কিন্তু সেটা কোন মানুষের লেখা বলে মনে হলনা। আপনাদের আমি ডায়েরিটা খুলে কিছু লেখা দেখাচ্ছি। দেখুন আপনি ই পড়ে। কোণ মানুষের লেখা বলে আপনার কি মনে হবে? দেখুন।

পৃষ্টা ১
আমার ডানার ভাঁজে আজকে আটকে গেছিল একটা শুয়ো পোকা। ফলে আমি উড়তে পারছিলাম না। আমার নখ দিয়ে বের করে পোকাটাকে খেয়ে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শুয়ো পোকা আমার খাবারের তালিকায় পড়েনা। আমি খাই মৌমাছি- কেন্নো আর রুথের ডিম(রুথের ডিম কি জিনিস আমি বুঝিনি)। আর আমার ডানা গুলো এতই বড় যে মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাখিও এসে আটকে যায় ডানার ভাঁজে। আমি সেই চড়াই আর বাবুই পাখিদের ও উৎসাহ নিয়ে খাই। কিন্তু আমি শুয়ো পোকা আমি খাইনা। থাক এখন আর লিখতে ইচ্ছে করছেনা। এখন ঘুমাব। বিদায়।

পৃষ্টা ২
সকাল হলেই মোরগ নামের পাখিটা ডেকে ওঠে। আর এই জন্য আমার মাঝে মাঝে মোরগ নামের পাখি গুলোকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি নিজে পাখি হয়ে কিভাবে অন্য পাখিকে এই সামান্য কারনে মেরে ফেলবো? তাই আমি কিছু বলিনা। শুধু চেয়ে চেয়ে সূর্যাস্ত দেখি ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর। সূর্য ভেদ করে পাখি দের উড়ে আসা দেখতে আমার ভাল লাগে। আমি নিজেই অনেক চেয়েছি সূর্যের ঠিকানায় উড়ে যাব। কিন্তু বেশি উপরের দিকে উড়তে গেলেই আমার ডানা পুড়তে শুরু করে। আমার শরীর ভারী হয়ে যায় নিমেষেই। আমি নিচের দিকে পতিত হই। আমি পড়ে যেতে থাকি। আর নিচ থেকে মাটি আমাকে কাছে ডাক্তে থাকে। আমি কোন দিন সূর্যের কাছে যেতে চাইনি।

পৃষ্টা ৩
গ্রিসে আমি চেয়েছিলাম সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকব। কিন্তু পারিনি। আমার উড়বার নেশা আমাকে ভাল থাকতে দেয়নি। সেখানেই এক পাখি গবেষক আমাকে এই পাখা গুলো কিভাবে শরীরে জোড়া দিতে হবে সেটা শিখিয়েছিলেন। চাইলেই জোড়া দেয়া যায়-চাইলেই খুলে ফেলা যায়। কিন্তু খুলে ফেলে চাইলেই স্বাভাবিক হওয়া যাবেনা। কারন আকাশে উড়ার নেশা থেকে আবার বেরিয়ে পড়তে হবে সুনীল দিগন্তের দিকে।

পৃষ্টা ৪
কিছু লেখা নেই

পৃষ্টা ৫
হিজিবিজি সব আর্ট।

পৃষ্টা ৬
পাখিদের চাল চলন আঁকা।

পৃষ্টা ৭
পাখিদের ডানা জোড়া লাগিয়ে বিরাট ডানা বানানোর কৌশল। কিভাবে ওড়া যাবে সেটার কৌশল।

পৃষ্টা ৮
ডানার মাঝে কিভাবে প্রাণ সঞ্চারন করা যাবে সেটার কৌশল !!!


আট নম্বর পৃষ্টা পড়েই বুঝলাম আসলে চাচা শয়তানের পাল্লায় পড়েছেন। বিশাল পাখা বানিয়ে আকাশে ঊড়ানোর নাম করে পাখার মাঝে প্রাণ নিয়ে আসার বর্ণনা বড়ই ভয়াবহ। অনেক খারাপ কাজ করতে হয়। পাখিদের মত অনেক উল্টা পাল্টা জিনিস খেতে হয়। আমি পড়েই ওয়াক করে বমি করে পড়া বন্ধ করলাম ডায়েরিটা।

পরের দিন আমি স্কুলে গেলাম স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু পড়ায় মন বসছেনা। স্কুলে আমি ফার্স্ট বয়। ক্লাস নাইনে আমার চাইতে কেউ কোন পড়া ভাল ভাবে মুখস্থ বলতে পারেনা। এই কারনে আমি ই সেরা। আর টিচাররা সব সময় আমাকে দাঁড় করিয়ে মুখস্থ বলাতেন। এতে আশে পাশের ছাত্ররা হিংসায় জ্বলে মরত। সেদিন কি হল আমি আর মুখস্থ বলতে পারলাম না। আমার মনে হচ্ছিল আমি বিজ্ঞান এর সব পড়া ভুলে গেছি। মাথায় ঘুরছে কেবল পাখি বিষয়ক চিন্তা ভাবনা।

বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরি চত্তরে গেলাম। সেখানে পাখিদের নিয়ে যত বই আছে সব পড়া আর নোট করা শুরু করলাম। এভাবে দিন দশেক পর আমার লেখা পড়া শিকেয় চড়ল। মাথায় ঢুকল পাখির ডানা বানানোর ঝোঁক। খাতা ভরল পাখিদের স্কেচে।

এর পর একদিন পরীক্ষা আসল। আমি পরীক্ষাটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। পরীক্ষা শেষেই বিশাল লম্বা ছুটি। আমি ছুটি শুরু হতেই চলে গেলাম আমার ছোট বেলার খেলার যায়গা চিলে কোঠায়। সেখানে আমার অনেক খেলনা যন্ত্রপাতি আছে। সেই সব জঞ্জাল সরিয়ে আমি আমার ওয়ার্ক শপ বানালাম। আর এর পর শুরু হল খেয়ে না খেয়ে আমার ডানা বানানোর গবেষনা। এর মাঝে আমি গ্রিক উপাখ্যান পড়ে ফেলেছি। সেখানে ইকারুস নামে একজন মানুষের কথা লেখা আছে যে মোমের ডানা কাজে লাগিয়ে আকাশে উড়েছিল। আমার চাচার ডায়েরি আর সেই ইকারুসের কাহিনী মিলিয়ে দেখলাম এক আশ্চর্য মিল। চাচার ডানা গুলো ও ইকারুসের মত সূর্যের দিকে গেলেই গলতে শুরু করত।

আমি ও এখানেই পেয়ে গেলাম আমার পাখা বানানোর রসদ। বাজার থেকে কিনে আনলাম কাঠ কাটার মেশিন আর কাঠ। বাঁশ এর জন্য গেলাম কাছের বাঁশ পট্টিতে। সেখান থেকে মজবুত কিছু বাঁশের টুকরা কিনে আনলাম ফুট দশেক। আর কিনলাম সাড়ে তিন কেজি মোম। এরপর শুরু করলাম আমার কাজ। মা বাবা মনে করলেন আমি কোণ একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি। তাই আমাকে বিশেষ ঘাটালেন না। কারন আমাদের পরিবারের পুরুষ মানুষ দের কে ঘাটালেই উনারা বিশেষ কোন অঘটন ঘটিয়ে দিয়েছেন। তাই আমাকে ও বেশি ঘাটানো হলনা।

আমি প্রথমেই সাইজ করা কাঠের উপর এঁকে ফেললাম পাখির পালক। তারপর সেই আঁকা অনুযায়ী কাঠ খোঁদাই করে বানিয়ে ফেললাম পালকের ছাঁচ। তারপর কড়াইয়ের উপর মোম গলাতে বসালাম। চুলা বানালাম ছাদের চিলেকোঠাতেই। এর পর সেই মোম গলে যেতেই কাঠের উপর সেই মোম ফেলে আরেকটা কাঠ দিয়ে চাপ দিয়ে ডুবিয়ে দিলাম ঠান্ডা পানিতে। খুব দ্রুত আমার মোমের পালক তৈরি হল। সামান্য একটু মোম বেশ দ্রুত ছড়িয়ে গেল পালকের মত। আসল পালক আর এই পালকের মাঝে পার্থক্যই হল এটা পাখির শরীর থেকে আসেনি।

এর পর আমি আরো কয়েকশো কিংবা কয়েক হাজার পালক বানালাম পাঁচ দিন বসে বসে। এর মাঝে শুধু ঘণ্টা খানেক কাটিয়েছি খেয়ে আর ঘুমিয়ে।

পালক বানানো শেষ হতেই আমি সেগুলো লাগানোর জন্য কাঠ আর বাঁশ দিয়ে ফ্রেম বানাতে শুরু করলাম। আর ফ্রেম হিসেবে পছন্দ হল আমার বাদুরের পাখার স্ট্রাকচার কে। বাঁশ কেটে ছেটে সুন্দর করে চিকন তার দিয়ে বেঁধে বানিয়ে ফেললাম একটা ফ্রেম। এরপর শুরু হল ফ্রেমের সাথে পালক লাগানোর কাজ। আমি একটার উপর একটা দিয়ে দিয়ে ঘন করে বানালাম ডানা।আমি চিন্তিত ছিলাম উড়ার ব্যাপারটা নিয়ে। তাই আমি ডানার সাথে নিজের হাতের সংযোগ রাখলাম। কিন্তু হাত দিয়ে নেড়ে কতদুর ই বা উড়া যাবে। ইতিহাসে অনেক মানুষের মৃত্যুর কাহিনী লেখা আছে এই হাত দিয়ে উড়তে গিয়ে। পাখা বানানো শেষ হতেই আমি কাঁধে জুড়ে দিয়ে প্রাকটিস করলাম। কিন্তু কোণ কাজ হলনা। আমি সবার অলক্ষ্যে রাতের বেলা চিলে কোঠা থেকে লাফ দিয়ে ছিলাম পাখা শরীরে লাগিয়ে। কিন্তু না- হাত দিয়ে উড়ে বেশি দূর যেতে পারলাম না। ফূট খানেক ঝাপটা ঝাপ্টি করেই আমি ধপাস। ভাগ্যিস আমি পড়েছিলাম আমার সাধের ফুলের ঝোপের উপর। তাই রক্ষা। অন্য কোথাও পড়লে নির্ঘাত কোমড় ভেঙ্গে ফেলতাম।

এই করতে গিয়ে আমার পালকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমি সেই ক্ষতি পূরন করতে করতে গেল আরো দিন চারেক। কিন্তু কিভাবে এটাকে ওড়াব সেই চিন্তায় পড়লাম। মেশিনের সাহায্যে উড়ানোর চিন্তা মাথায় এসেছিল। কিন্তু পারলাম না। কারন মেশিনের ওজনেই আমি মাটিতে পড়ে যাব। এর মাঝে না খেয়ে কম খেয়ে শরীরের ওজন কমিয়ে ফেলেছিলাম। তাই আমি সহজেই ভেসে থাকতে পারলেও মেশিনের ওজন রাখবে কিভাবে পাখাটা?

ভাবতে ভাবতে হটাত করে সেই চাচার দেয়া ডায়েরির কথা মনে পড়ল। সেখানেই ডানাটার নিজে নিজেই উড়ার কথা লেখা ছিল। আমি সেটা বের করে পড়া শুরু করলাম। রীতিমত শয়তানি কাজ কারবার।ডায়েরির কথামত প্রথমেই একটা মুরগী মেরে সেটার মাথা কেটে নিয়ে আসলাম। আর বাজার থেকে কিনে আনলাম একটা গরুর মাথার হাড়। এক জোড়া সোনা ব্যাঙ্গ নিয়ে এসে চার হাত পা বেঁধে ফেলে রাখলাম মেঝেতে। তারপর একটা সাপ জোগাড় করলাম।সাপটাকে মেরে গোল করে ছড়িয়ে দিলাম ব্যাঙ্গ দুটোর সামনে। ঠিক যেমনটা আঁকাছিল ডায়েরিটাতে।আর এরপর মুরগীর রক্ত দিয়ে গোল একটা ঘোড়ার খুড় এঁকে সেটার ভেতর একটা বসার আসন।

এরপরের কাজ খুব সহজ। চাঁদ হীন রাতে আমাকে সেই আসনে গিয়ে বসতে হবে। আমি অপেক্ষা করলাম দুইদিন। দুইদিন পরেই অমাবস্যা রাত। আমি সেই রাতে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলাম আমার সেই চিলেকোঠায়। এরপর সেখানে ডানা টা পড়ে নিলাম আমার কাঁধে। কাঁধে পড়ার পর পর ই আমার মনে হচ্ছিল পেছন থেকে কেউ একজন দেখছে। কিন্তু আমি ভয় পাইনি। ডানা দুটো বাঁধা অবস্থাতে ভাঁজ করা থাকে। মনেই হয়না শরীরে কোন ডানা আছে। পিঠের পেছন দিকে এটে যায়। সেই অবস্থায় আমি বসলাম সেই আসনে। অবাক হয়ে দেখলাম দুইদিন আগে রক্ত দিয়ে আঁকা আসন দুইদিন পরেও তরতাজা আছে।
এরপর আমি সেই ডায়েরি থেকে একটা মন্ত্র পড়া শুরু করলাম। মন্ত্রটা হল-
“ইলোডা আবোঢে ইঠো ইরম ইহম”।

মন্ত্র টা কেমন যেন ভয়াবহ। মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে। সাথে মাথাকে ঘুরাতে থাকে। আমি আবিষ্ট হয়ে গেলাম। আমি বার বার পড়তে লাগ্লাম সেই মন্ত্র।

“ইলোডা আবোঢে ইঠো ইরম ইহম”

“ইলোডা আবোঢে ইঠো ইরম ইহম”

“ইলোডা আবোঢে ইঠো ইরম ইহম”

“ইলোডা আবোঢে ইঠো ইরম ইহম”

“ইলোডা আবোঢে ইঠো ইরম ইহম”
.................................


পরের দিন ঘুম ভাঙ্গল বেশ বেলা করে। আমি আসলে সেই মন্ত্র পড়তে পড়তে ঘুমিয়েই গেছিলাম। কিছু হয়েছিল কিনা জানা নেই। ঘুম ভাঙতেই নিজেকে সেই আসনের উপর পা ছড়িয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলাম। উপুর হয়ে পড়ে আছি আমি। এমন সময় অনুভব করলাম আমার পেছনে ঘাড়ের উপর কিছু একটা নড়ছে। কেমন যেন নাচের ভঙ্গিতে। ভয় পেলাম। দ্রুত উঠলাম। কিন্তু পেছনে কাউকে দেখতে পেলাম না। হটাত করে টের পেলাম আমার পেছন ডানা দুটো নিজে থেকে ই নড়ছে।

নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এই সাধনা কাজে দেবে সেটাই আমি বুঝতে পারিনি। আনন্দে লাফ দিতে গিয়েই দেখলাম আমি ভাসছি-ডানা গুলো নিজ থেকে নড়ে নড়ে আমাকে ওড়াচ্ছে। এই প্রথম বাতাসে শরীর ভাসিয়ে আমি নিজেকে গর্বিত অনুভব করলাম। আনন্দে হটাত করেই ভুলে গেলাম আমি কে। এমন সময় ঘটল ঘটনাটা। কাঁধে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হল। যেখানে ডানা দুটো লাগানো ছিল সেখানে। ব্যাথায় কুকড়ে গেলাম আমি। পড়ে গেলাম ছাদের মেঝেতে। বুঝলাম কিছু একটা আমার হাতের দিকে এগিয়ে আসছে শরীরের ভেতর দিয়ে। পরক্ষনেই দেখলাম আমার শিরা গুলো কালো কালো হয়ে নেমে যাচ্ছে হাতের আঙ্গুল বেয়ে। আর আঙ্গুল বেয়ে নেমেই খচ করে বের হয়ে এল লম্বা লম্বা নখর। নখ গুলো দেখেই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলাম আমি। প্রচন্ড ধারালো নখ গুলো দেখেই বুঝে ফেললাম আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। এই ডানা দুটো এখন আমাকে চালিত করবে। আমি আর নিজের উপর আয়ত্ব রাখতে পারলাম না। ডানা দুটো আমাকে নিয়ে উড়তে শুরু করল ঘর জুড়ে। মাথার উপর ছাদ বেশ নিচু ছিল বলে মাথায় আঘাত পেয়ে যখন অবস্থা খারাপ তখন খেয়াল পড়ল জানালার উপর।

আমি জানালা খুলে একটা লাফ দিলাম। সাথে সাথে আকাশে ভেসে উঠলাম আমি। সাময়িক আগের মনের খেদ সাথে সাথে আনন্দে পরিনত হল আমার। মনে হচ্ছে আমি পৃথিবী জয় করে ফেলেছি। হটাত করে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করল আমার খুব। সাথে সাথে মনে কথা বুঝতে পেরে আমি উড়তে লাগলাম। ঝট করেই পায়ের নিচে নিজের ছায়া অনেক বিরাট হয়ে গেল। আমি আকাশের উড়ে চললাম। আমি বাতাসের বিরুদ্ধে উড়লাম। ডানা গুলো বেশ সুন্দর ভাবে আমার মনে কথা বুঝতে পারছে। আমি বাতাসে ডানা ভাসিয়ে পাখিদের মত ভেসে থাকলাম। ধীরে ধীরে ঊড়ার ব্যাপারটা আয়ত্বে এনে ফেললাম আমার ঘণ্টা খানেক পরেই। এমন সময় দেখলাম ব্যাপার টা। আকাশে সূর্য তখন মাথার উপর উঠি উঠি করছে- আর কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে সূর্যের দিকে।

সাথে সাথে আমি মনস্থির করলাম সূর্যের দিকে যাবার। সেই ভাবা সেই আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল ডানা দুটো। ওদের শরীরে এখন প্রাণ আছে। ওরা আমার কথা বুঝতে পারে। আমি উড়ে যেতে লাগলাম বিশাল পাখির মত। হাত দুটো কে আমার অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে ডানা গুলো সক্রিয় হবার পর। আমি দ্রুত উড়ে চলেছি। আকাশে অনেক পাখি। কিন্তু সবাই আমাকে দেখে ভয়ে এদিক সেদিক সড়ে যাচ্ছে। চিলের দল থাকলে নির্ঘাত আমাকে দেখে ভয় পেত। আমি আকাশ থেকে ই একটা পাখি ধরে কুট কুট করে ভাসমান অবস্থাতেই খেয়ে নিলাম। এরপর আবার উড়া শুরু করলাম। আমাকে দ্রুত যেতে হবে। সূর্য মাথার উপর ওঠা শুরু করেছে। এর আগে যেতে না পারলে আমি মরে যাব বলে মনে হচ্ছিল আমার।

হটাত টের পেলাম আমার চারপাশে ধুলোর মত মেঘের কণা ভেসে ভেসে আসছে। আমি হাত দিয়ে কিছুক্ষন মেঘ ধরলাম। তারপর মেঘ ভেদ করে আরো উপরে উঠতে চাইলাম। কিন্তু ডানা গুলো সায় দিচ্ছেনা উপরে উঠার জন্য। মাথায় ভুত চেপে বসল আমার। শাসালাম ডানা দুটোকে। শেষে আমার কথা শুনে ওরা আরো উপরে নিয়ে গেল আমাকে।

এমন সময় প্রচন্ড গরমে আর বাতাসের অভাবে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে এল। কিন্তু মাথা ঘুরে গেল ডানার দিকে তাকিয়ে। দেখলাম গরমে আমার ডানা গলতে শুরু করেছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি একটা ডাইভ দিলাম নিচের দিকে। ততক্ষনে আমি বাড়ি থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছি। অনেক নিচে আমি মেঘ দেখতে পাচ্ছি। আমাকে দ্রুত মেঘের কাছে যেতে হবে। তাহলে মোমের ডানা বাঁচানো যাবে। কিন্তু তার আগেই বেশ কিছু পালক চোখের সামনেই ঝরে পড়ল। আমার মাথা ঘুরে গেল দেখার সাথে সাথে। আমি দ্রুত নামতে চেষ্টা করছি। এমন সময় খেয়াল করলাম আমি পড়তে শুরু করেছি। কারন ডানা দুটো ওরা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি হাত দিয়ে ডানা দুটো ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেগুলোতে কোন প্রাণ ছিলনা। আমি পড়তে শুরু করলাম ডানা গুলো নিয়ে। কোন কিছু একটা ধরার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু কিছুই ধরতে পারছিনা। আমি মেঘের সামনে দিয়েই ভেদ করে পড়লাম। মেঘ আমাকে ঠাই দিলনা। আমি বাতাসে ভাসতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। এমন সময় দেখলাম আমার নিচে সুনীল সমুদ্র। আমি পড়তে চলেছি সমুদ্রে। মনে পড়ল আমার- আমি আকাশে উড়তে শিখলে ও সমুদ্রে সাঁতার শিখিনি কখনো।।

৪টি মন্তব্য: