৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২

কাসাফাদ্দৌজা নোমান

খোঁজ

হাঁটতে হাঁটতে পায়ের লিগাম্যান্ট বোধহয় ছিড়েই গেল। না জানি কপালে আরও কথা হন্টন আছে।“সাগর বাইন্ডিংস” খুজছি গত এক ঘন্টা যাবত। বাবার বন্ধুর দোকান। বড় বোনের বিয়ের দাওয়াত পৌছে দিতে হচ্ছে এটা ভেবেই কষ্ট লাগছে। বিয়ের দাওয়াত দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত না আবার নিজের কুলখানীর দাওয়াত দিতে হয়! এই মোবাইলের যুগে বিয়ের দাওয়াত স্ব-শরীরে পৌছে দেয়ার কি দরকার মাথায় ঢুকছে না। বাবারা পারেও বটে। গত বাইশ বছর বাবার সাথে তার বন্ধুর কোন যোগাযোগ নেই অথচ নিজের মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে হবে। তাও আমাকে এসেই দিতে হবে। অবশ্য কিছু করারও নেই। বাবা শাররীক অবস্থা যা আসা একেবারেই অসম্ভব। “ওই ভাই সাইড দ্যান”। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা পুরো দখল করে নিয়েছিলাম।

যাহ শালা সাগর বাইন্ডিংসের ঠিকানায় শেষ পর্যন্ত পৌছালাম। কিন্তু একি এখানেতো “শাহ ফার্মেসি”। কোথায় বাইন্ডিংস কোথায় ফার্মেসি। মাথায় ওরস্যালাইন ভেঙ্গে পড়লো। জব্বার হোসেন বোধহয় বাইন্ডিংসের ব্যবসা ছেড়ে ফার্মেসির ব্যবসা শুরু করেছে। দেশে বই বাঁধানোর চেয়ে অসুখ বাঁধানোর হারতো বেশীই!
-জব্বার চাচা আছে?
দোকানির মুখ কুচকানো দেখে মনে হচ্ছে আমি বোধহয় ভিনগ্রহের কোন প্রাণীর খোঁজ করছি।ব্যাটা কেবল মুখ কুচকাতে না নাকও কুচকাতে জানে। “ইয়ে মানে জব্বার হোসেন, ওই যে আগে বাইন্ডিংসের দোকান ছিলো…
-ওহো জব্বারের কতা কইতাচেন দেহি। হে তো দোকান ছাইড়া দিছে আরও বছর দশেক আগে।কত দোকান হইলো এইখানে। রড সিমেন্ট পার কইরা এখন ঔষুধের দোকান। তা হের কাছে আফনের কি কাজ শুনি?
ব্যাটা বেশী কথা বলে। পুরান ঢাকার লোকজন এমনিতেই বেশী কথা বলে।“কাজ বলতে উনি আমার বাবার বন্ধু হন, আমার বোনের বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছি”
-লোকটার অবস্থা খুব বেশী ভালা না। অভাবে পইড়া আমার কাছে সব বেইচা থুইছে।খাড়ান ঠিকানা লেইখা দিই।

বুঝলাম অবস্থা কিছুটা খারাপ বটে।ঠিকানা নিয়ে বের হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। হাতে রাখা বিয়ের কার্ডের অবস্থা তথৈবৈচ। ঘামে ভিজে একাকার। ঠিকানাটা বেশী দূরে না। তবে পুরান ঢাকায় ঠিকানা না খুঁজে হাতির শুড়ের মধ্যে পিপড়া খোঁজা ভালো। নাম নয়াবাজার, সবকিছু কেমন পুরান। আমি মেয়র হলে এই এলাকার নাম দিতাম পৌরানিক বাজার।এমনেই সামনে বোনের বিয়ে, সেটা নিয়ে বেশ উত্তেজিত। দুলাভাইকে কত খসানো যায় সে ধান্ধায় কাজিনরা সবাই ছক আঁকছে। আমি শালা দাওয়াত দিতে দিতেই ক্লান্ত। আপুর হবুজামাই মালদার পার্টি। মাল্টি ন্যাশেনাল কোম্পানীতে ভালো অবস্থায় আছে। আপুর জন্য পাঠানো গিফটের বাহার দেখে বুঝা যায় আমার ভবিষত আলোকিত। তার উপর তার দুকুলে কেউ নাই। মা-বাবা নিজের মেয়ের শান্তির জন্য শ্বশুড়-শ্বাশুড়িহীন ঘরে বিয়ে দিচ্ছে। মায়ের কথামত “যে ঘরে শ্বাশুড়ি নেই সে ঘরে মেয়েরা সুখে থাকে। বহু সিগারেট পুড়িয়ে অবশেষে জব্বার চাচার বাসা খুঁজে পেলাম। বাসা না বলে খুপরি বলা ভালো। স্যাঁতস্যাতে দরজা মাড়িয়ে অন্ধকারছন্ন ঘরে প্রবেশ করলাম। খালি গায়ে এক বৃদ্ধ শুয়ে আছে। শরীরে অবশিষ্ট মাংশটুকুও ভিতরে ঢুকে গেছে। ইনি জব্বর চাচা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
-চাচা আমি শরীফ আহমেদের ছেলে
চাচা চোখ খুললেন।আমার চেহারা ভালো করে দেখে নিজের মনেই কি যেন ভাবলেন। এরপর কাছে টেনে আমার কপালে চুমু খেলেন।
-তোর যখন জন্ম হয় তখন তোকে দেখতে চেয়েছিলাম। একবারে বড় হবার পর দেখলাম। কি তাগড়া হয়েছিসরে।
চাচার উচ্চারণ শুণে রীতিমত মুগ্ধ হলাম। শুনেছি চাচা খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিলো।কবিতা গল্প নিয়ে বেশ মাতামাতি করতেন। শেষ পর্যন্ত বাবার ব্যবসা দেখতে গিয়ে কবিতা মাঠে খুন করে সাগর বাইন্ডিংস এর হাল ধরেছেন।
-চাচা শুনেছিলাম আপনার একটা ছেলে ছিলো। সে কোথায়? আপনিই বা এখানে কেন?
দীর্ঘশ্বাসে অনেক কথা বলে দেয়।চাচার দীর্ঘশ্বাসে ঝীর্ন শরীর কেঁপে উঠলো। সে অনেক কথা, শুনে কাজ নেই।তুই বরং বল শরীফ কেমন আছে?
-বাবা ভালো আছে।প্যারালাইসিসে বাবা প্রায় অচল। ঘর থেকে বের হতেও পারেন না।
-আমারতো প্যারালাইসিস হয়নি। হাঁটতে পারি, তবুও চলতে পারিনা।
-চাচা আপনি নাকি কবিতা লিখতেন? এখনও লিখেন?
-কবিতাকে ছেড়ে দিয়েছি আরও বারো বছর আগে। জীবনটাই একটা কবিতা, যে কবিতা মাঝে মাঝে স্তব্দ করে।
আমার তাড়া আছে, তাই আর কথা বাড়ালাম না। “চাচা আপুর বিয়ে, আপনাকে দাওয়াত দিতে এসেছি। বাবা আসতে পারলে নিজেই আসতো।বাবা খুব করে বলেছে। আপনি অবশ্যই যাবে চাচা। এই নেন কার্ড”
-আমার যা অবস্থা তাতে যেতে পারবো কিনা জানিনা। তবে যাওয়ার চেষ্টা করবো।কার্ডটা টেবিলে রেখে দাও।পরে দেখবো আমি।
-চাচা আমি যাই?
-যাও, তোমাকে কিছুই খাওয়াতে পারলাম না।
-না চাচা আপনি একা মানুষ।

বেরিয়ে আসলাম ঠিকই, তবে মনে কেমন যেন করে উঠলো। চাচা তুই থেকে তুমি বললো। নাহ গিয়ে চাচার এরকম অবস্থার ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করি।শুনেছি বেশ টাকা পয়সা ছিলো। কিভাবে এরকম হলো জানা দরকার। তাছাড়া বাসায় গেলে বাবা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করবেন।চাচা শুয়েই ছিলেন, পাশে বিয়ের কার্ডটা আগের অবস্থায় পড়ে আছে। দেখেই বুঝা যায় কার্ডটা এখনও পড়েননি।
-চাচা আমি আবার আসছি
জব্বার চাচার মুখটা বেজায় শুকনো।“চাচা আপনার গল্প শুনবো, বাবা জানতে চাইবেতো।
-কি শুনবি বল
-গত বাইশ বছর বাবার সাথে আপনার যোগাযোগ ছিলো না। সে গল্প যা বাবা জানেনা। বাবাকে আপনার গল্প বলে আমি চমকে দিবো।
হা হা করে চাচা হাসলেন। দেখে বড্ড ভালো লাগলো।“শোন তাহলে।কবিতা লিখতাম।তোর বাবা ছিলো আমার কবিতার একমাত্র পাঠক, হা হা হা। টিএসসিতে এক সাথে কত আড্ডা দিয়েছি। আমার উদাসীনতা দেখে বাবা বিয়ে করিয়ে দিলেন।পরের বছরই বাবা গেলেন মরে। মা আরও আগেই চলে গিয়েছিলো।আমি পড়লাম মহা ফ্যাসাদে। এদিকে আমার বৌয়ের পেটে আবার বাচ্চা।উপায় নাই তাই বাবার “সাগর বাইন্ডিংস” এর হাল ধরলাম।আমার কবিতা সব সাগর বাইন্ডিংসে হারিয়ে গেল। তখনও তোর বাবা মাঝে মাঝে আসতো।
-চাচা তখন কি আমার জন্ম হয়েছিলো?
-হা হা হা, নারে তুই তখনও পৃথিবীতে আসিসনি। তোর বোনও আসেনি।আমার ছেলে হল,কিন্তু বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে তোর চাচী গেল মরে। আমি এবার চোখে মুখে কোন পথই দেখলাম না।সাগর বাইন্ডিংসের পিছনেই একটা বাসা নিয়ে আবিদকে নিয়ে সংসার পাতলাম। ও হ্যাঁ আবিদ আমার ছেলে।
নামটা কেন জানি পরিচিত মনে হচ্ছে। যাই হোক আবিদ নামের অন্তত বিশটা ছেলেকে আমি চিনি।আমি গল্পে মনেযোগ দিলাম। চাচা শুরু করলেন “বছর তিনেক পর একটা অবস্থায় আসলাম। একদিকে দোকান আরেকদিকে আবিদ। অনেকেই বলেছিলো আরেকটা বিয়ে করতে। একটাই করেছি বাবার জোরাজুরিতে, আবার আরেকটা? আবিদের জন্য একটা মহিলা রাখলাম।আবিদের তখন ছয় বছর, সেবার তোর বাবা শেষবারের মত আমার দোকানে এসেছিলো তোর জন্ম হবার খবর নিয়ে।তার বছর তিনেক আগে অবশ্য তোর বোনের জন্ম হয়েছিলো
-তারপর
-আবিদ বড় হতে থাকলো।একটা সময় ঘোর বিপদে পড়লাম। সাগর বাইন্ডিংসের ক্যাশ চুরি হলো।সেদিনই ব্যাংক থেকে সব টাকা এনে রেখেছিলাম একটা কাজে। এদিকে আবিদের তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা দরকার। কোন দিকেই কোন টাকা পেলাম না। শেষে দোকানটাই বিক্রি করে দিলাম। পুরো টাকাটা আবিদের নামে ব্যাংকে রাখলাম। এতেই ওর পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন চলে যাবে।আমি হয়ে পড়লাম বেকার। আমার কাছে কিছু টাকা ছিলো সেটা দিয়ে চলতাম ঠিকই কিন্তু কাজ ছাড়া কি আর থাকা যায় বল?
-তা ঠিক চাচা
-আবিদেরও যেন কি হল। ওকে বললাম আমার সাথে থাকতে। ও না থেকে হলে উঠে গেল।একবছর যেতে না যেতে আমার কাছে আসা কমিয়ে দিলো। একবার টানা তিন মাস আসলো না। আমি ভয় পেয়ে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে খবর নিয়ে জানতে পারলাম ও স্কলারশীপ নিয়ে আমেরিকায় চলে গেছে।শুনে বুকটা ভরে গেল।কিন্তু জানিস এরপর ওর কোন খোঁজ পাইনি।আমাকে দেখতে কখনই আসেনি।কতবার গিয়েছি ওর ডিপার্টমেন্টে,কিন্তু ওর খোজ পাইনি।নিজের বুকের ধনকে হারিয়ে আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। সারাদিন বই পড়ে কত আর থাকা যায়। সারাজীবন অসামাজিক ছিলাম। তাই কারো সাথে কখনও যোগাযোগ করা হয়নি।
চাচার চোখের পানিতে আমি কাঁদিনি ঠিকই। তবে গা শিরশির করছিলো। আবিদের উপর ভয়ানক রাগ হচ্ছিলো। এত সুন্দর করে যার বাবা কথা বলতে পারে সে কিভাবে এই কাজ করে।
-চাচা শেষ কখন আবিদ ভাইকে খুজেছেন?
-চার বছর আগে একবার গিয়েছিলাম ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেউ কোন খোঁজ দিতে পারেনি। ওর কোন বন্ধু বান্ধবকেও চিনিনা যে জিজ্ঞেস করবো। তুই খুঁজে দিতে পারবি?
-চেষ্টা করে দেখবো। তবে আপুর বিয়ের পর। আবিদ ভাইয়ের পুরো নামটা কি?
-হাসান আবিদ,দেখতে অনেক সুন্দর ছিলো একদম তোর চাচীর মত। এখন বোধহয় আরও সুন্দর হয়েছে।
চাচাকে বিয়েতে আসতে রাজি করালাম এবং আবিদ ভাইকে খুঁজে দেয়ার কথা দিয়ে বের হলাম।টেনশনে মাথা কাজ করছে না। পা দুটি নিথর হয়ে আছে। যেন আর এগুতে চাচ্ছে না।ঘামে একাকার হয়ে ছিড়ে যাওয়া প্যাকেট থেকে একটি বিয়ের কার্ড বের করলাম।কার্ডের একটা অংশে লিখা আছে
পাত্র :হাসান আবিদ
পিতা : মৃত জব্বার হোসেন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন