৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২

শুভ্র নীল

অনুগল্প সমগ্র-

১.মইনের বাসার বারান্দাটা বেশ বড়, প্লাস্টিকের একটা মোড়ায় বসে সুন্দর আকাশ দেখা যায়। ইদানিং এখানে বৃষ্টি হচ্ছে খুব সারাবেলা। বারান্দায় বসে হাজার রকম ইচ্ছা-অনিচ্ছার ছবি আঁকে মইন। সামনের ছয় তলার বারান্দার তারে ঝুলিয়ে রাখা কাপড়ের মালিকিনকে দেখতে ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু কখন যে কাপড় দিয়ে যায় আর কখন নিয়ে যায় টের পায়না মইন। কিংবা তিন তলার সেই নিঃসঙ্গ তরুণীটির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে যে কিনা অলস বিকেলটা একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। জানতে ইচ্ছে করে তার বিষণ্ণতার কারণ। এই ইচ্ছেটাও অনিচ্ছায় রূপ নেয় যখন তরুণীর বাচ্চাটি হঠাৎ পেছন থেকে এসে দু হাত দিয়ে চোখ ধরে বসে মায়ের। মইন ইচ্ছে বদলিয়ে ভাবার চেষ্টা করে সেই মেয়েটির কথা, যে তার বারান্দার দরজা অল্প একটু খুলে দ্রুত ওড়নাটি নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়, আর খানিকক্ষণ বাদে লাইট বন্ধ করে জানালার পর্দার ফাঁকে খুঁজতে থাকে। তখন মইনের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, এই যে আপনি লজ্জা পাবেন না, আমি আপনার কোন দেহ আবয়ব দেখিনি। শুধু বুঝতে পেরেছি আপনি কম সময়ে ওড়নাটি নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। আপনার কোন দোষ নেই। আড়াল থেকে আমাকে দেখার কিছু নেই। দেখতে হলে দরজা খুলে বারান্দায় আসুন। রাতে ইলেক্ট্রিসিটি যখন চলে যায় কারো সাথে বাসার নিচের রাস্তায় হাঁটতে ইচ্ছে করে তার। ওপাশের বিল্ডিং এর থলথলে শরীরের বাল্য বন্ধু ইশতিয়াকের কথাও ভাবতে ইচ্ছে করে। ব্লেড দিয়ে বন্ধুকে খুন করার কথা প্রায়ই ভাবে সে। এককালের সমাজতন্ত্র বলতে বলতে শাহবাগ চত্বরে মুখে ফেনা তুলে ফেলা ইশতিয়াক আজ পুঁজিবাদী কর্পোরেট সমাজের অধিপতি, তাই? না। শিরিনের কথা মনে করতে চায় না মইন। তারচেয়ে সামনের ছয় তলার বারান্দার তারে ঝুলিয়ে রাখা কাপড়ের মালিকিনকে দেখতে ইচ্ছে হয় তার।

২.আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বাবার সাথে বের হল সবে আট বছর পেরুনো আসিফ। বাবা বলল, চল তোমার এক চাচার বাসা থেকে বেড়িয়ে আসি। যাবার পথে মুদি দোকান থেকে ছোলা, ডাল, পেয়াজ, চিনি কিনতে দেখে আসিফ তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা আমাদের বাসার রোজার বাজার না করেছো গতকাল, আজ আবার কেন কিনতেসো এত সব? বাবা বলল, বলেছিনা এক চাচার বাসায় বেড়াতে যাব, তাই কিনতেসি। কিন্তু বাবা কারো বাসায় বেড়াতে গেলে তো আমরা এই সব নেই না, বলল আসিফ। বাবা আসিফকে বুঝিয়ে বললেন। কলেজ গেট পার হয়ে দোচালা একটা ঘরে গেল তারা। ঐ চাচা আসিফ আর তার বাবাকে দেখে প্রথমে লজ্জা পেলেও চলে আসার সময় জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।

১৬ বছর পর এক বন্ধুর মামা বাসায় ইফতারিতে পেঁয়াজু ভেঙ্গে মুড়িতে মেশানোর সময় বাবার কথা মনে পড়ে আসিফের। এত বছর পর হঠাৎ বাবার সেই বুঝিয়ে দেয়া কথা কানে বাজে তার, "বাবা আসিফ, আমাদের আশেপাশে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা আর্থিক দিক দিয়ে দরিদ্র হলেও আত্মসম্মান বোধ নামক একটা ব্যাপারের কারণে তারা কারো কাছে হাত পাততে পারে না, এরকম মানুষের বাসায় মনে করে এভাবে আমাদের বেড়াতে যাওয়া উচিত।" ইফতার মুখে নিতে গিয়ে ঐ চাচার মত বাবাকেও একবার জড়িয়ে ধরতে আসিফের ভীষণ ইচ্ছে হয়। বাবা নাই জানলো ইফতারিতে আসিফ কি খাচ্ছে!

৩.মতিন সাহেব চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে আছেন। ডাইনিং টেবিলে তার চার ভাই ও বসে আছে। এবার মতিন সাহেব কথা বললেন, জানছ তো সফি ইন্টারে কি রেজাল্ট করছে। এখন তোরা আমারে ক কি করা যায়?

কি করবো মানে কি? ওরে কন ভালো কইরা পইড়া আবার পরীক্ষা দিতে, বলে উঠে মেজো ভাই সিরাজ। অন্য ভাইরাও সিরাজের কথায় সায় দেয়।

আমি চাইতেছিলাম ওরে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াই, কিন্তু জানছ তো অনেক টাকার ব্যাপার, তোরা কিছু দিতে পারবি? মতিন সাহেব বললেন।

কি যে বলেন মিয়া ভাই আপনে। আপনের কি এত টাকা আছে? এইসব বাদ দেন। ওরে কন পড়তে। জানেন তো আমার অবস্থা, বললো সেজো ভাই শফিক।

ছোট ভাই রফিক বললো, ভাইজানের কি মাথা খারাপ হইয়া গেছে? এডা তো এমন ব্যাপার না যে আপনের পোলায় কইলো আর আপনে হ্যাঁরে তাল দিলেন।

এবার মতিন সাহেব এবার জোরে কাশি দিতে থাকলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, সারাটা জীবন তো মানুষের জন্য এত করলাম, সৎ ছিলাম বইলা নিজের জন্য কিছু করি নাই। তাই বইল্লা ছেলেডারে পড়াইতে পারুম না। আমারে দেখসছ জীবনে কারো কাছ থিকা সাহায্য নিয়া চলছি? আইজকা তোগো ডাকছি পরামর্শের লাইজ্ঞা, তোরা এমনে কইলে কি করুম?

মেজো ভাই সিরাজ গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলে, ভাইজান বুঝতেই পারতেছেন আমাগো সবার অবস্থা। বাবুর মায় কত দিন ধইরা অসুস্থ আর আমার খরচ অনেক বাইরা গেছে। আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে। আমি তো কষ্ট কইরা ঢাকায় একটা ঘর তুলছি। শফিক রফিকের তো কিছু নাই, পোলা পাইন গুলাও বড় হইতাছে। আপনের ডেমরায় আড়াই কাডা একটা জায়গা আছে না, ওইডা ওগো কাছে বেইচ্চা দেন। তাইলেই সমাধান।

তোরা আইজাকা যা, আমি পরে তোগো জানামুনে, বলেন মতিন সাহেব। ভাইরা বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে মতিন সাহেব ভাবতে থাকেন, কি করেন নাই ভাইদের জন্য । অফিস থেকে লোন তুলে, ওভার টাইম করে এদের মানুষ করছেন। বউয়ের ডিপিএস ভেঙ্গে বিদেশ পাঠিয়েছেন। নিজের বাসায় রেখে বড় করছেন, আলাদা থাকেন নি। ভাইদের বাংলা বিষয়টা পর্যন্ত মাস্টার দিয়ে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। আর এরাই কিনা তার শেষ সম্বল টুকু তাদের কাছে বিক্রি করে ছেলেকে পড়ানোর কথা বলে। অনেক অসুস্থ লাগছে তার। সারা রাত ঘুমাতে পারেন না। বিছানায় শুয়ে সফির মা জ্বরে কাতরাচ্ছে। মতিন সাহেব ভাবতে থাকেন, কাতরাক!

৪.আজ দিনটা আমার জন্য কতটা স্পেশাল তা বলে বোঝানো যাবে নাহ। আজ যে তোমাকে আমার প্রথম নিজের করে কাছে পাওয়া। গত সারারাত আজ দিনটার কথা ভেবে ঘুমাতেই পারছিলাম না। যে আমি দুপুর একটা-দু'টার আগে ঘুম থেকে উঠি না সেই আমিই না কিনা অ্যালার্ম দিয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠে গেলাম। দাঁত ব্রাশ করতে করতে দেখি হাতের নখ হয়েছে বিচ্ছিরি বড়। আধ ঘণ্টা ধরে নেইল কাটার খুঁজে অবশেষে মুক্তি। আগের রাতেই বলেছিলাম সেভ করে আসতে পারবনা, তাই আর সদ্য বড় হওয়া দাঁড়িতে অত্যাচার করলাম না। সকাল থেকেই ফোন দিচ্ছি কিন্তু ঘুমকাতুরে মেয়েটার ঘুম ভাঙাতেই পারছিলাম নাহ। ভেবেছিলাম ফুলহাতা শার্টের হাতা গুঁতিয়ে আসবো, মনের ভুলে হলুদ স্ত্রাইপের পোলো শার্ট পরে বের হয়ে গেলাম। অবশেষে দুজনের দেখা মিললো বসুন্ধরা সিটিতেই। তোমাকে সরাসরি দেখেই আমি টাস্কি! এত দেখি সাক্ষাৎ পরী নাকি দেবী? ভাবতে ভাবতেই হাত ধরে ছলে গেলাম লেভেল এইটে। আগেরই কথা ছিল দেখা হলে মুভি দেখবো সবার আগে। মুভি চলছিলো স্পীড, ও আমার দেশের মাটি, সুপার এইট, রাইস অফ দ্যা প্ল্যানেট অফ দ্যা আপেস। তুমি বললে শেষের মুভিটা ভাল। কিন্তু আমার তেমন পছন্দ না হওয়ায় মুভি দেখার প্ল্যান বাদ। বিএফসিতে বসবো নাকি ঢাকাইয়াতে এই নিয়ে চলল মমাঝারী টাইপ ঝগড়া। অবশেষে বিএফসি জয়যুক্ত হল। দেশি দশে ঢুকে কয়েকটা চক্কর মেরে চা খেয়ে বেরিয়ে গেলাম। এরপর শুরু হল রিকশা ভ্রমন, গন্তব্য ধানমণ্ডি। সাত-মসজিদ রোডেই চলল বেশি ঘুরা-ঘুরি। তারপর আনাম র্যাং গস এ। আনামে ঢোকার একটাই উদ্দেশ্য ছিল চুড়ি কেনা। কেন বুঝলাম না, তোমার মুড চেঞ্জ, আর কেনা হল না। তারপর হাত ধরে ঢুকলাম কজমোতে। অবশেষে রিকশায় রাইফেল স্কয়ার। উদ্দেশ্য শাদা ফুল কেনা। তোমার বাবার ফোন পেয়ে সিএনজি নিলাম বাসায় পৌঁছে দেব বলে। সারাটা রাস্তা একবার ও হাতটা ছাড়লেনা। এমন সময় তোমার ফোন। কই তুমি? বললাম এই যে তোমার সাথে সিএনজি করে যাই। তুমি বললে, পাগল হয়ে গেছ তুমি? আমি বললাম কি করবো! তোমাকে দেখার এত ইচ্ছা, তুমি আসতে পারছোনা, তাই কল্পনার তোমাকে সাথে নিয়ে অসাধারন একটা সময় কাটালাম। তোমার ফোনের এত কথা শুনার পরও আমার পাশের তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিলাম। আমার একটুকু অবিশ্বাস লাগলো নাহ। অথচ তুমি বিশ্বাস করছোনা। ভাবছো ভণ্ড না হয় মস্তিস্ক বিকৃত পাগল! আসলে আমি কি? এই শ্রেষ্ঠ সময়টা আমি তাইলে কার সাথে কি ভাবে কাটালাম?

৫.কিরে বাবা কথা বলছিস না কেন? বল না কোনটা তোর পছন্দ হয়েছে?
সাজু বুঝতে পারে না বাবাকে কি বলবে। বাবা বাসায় সারা দিনই পড়াশুনা নিয়ে বকা ঝকা করেন। এত দিন অরুর বলটা দিয়েই অরুর সাথে খেলত। আজ বাবা কিনা তাকে দোকানে নিয়ে আসছেন বল কিনে দেয়ার জন্য! কি বলবে বুঝতে পারেনা সে। চোখ-মুখ শক্ত করে ইশারায় দেখায় ওইটা।

সাজুর বাবা মিরাজ সাহেব গত কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলেন সাজুকে কিছু কিনে দিবেন। হাতে চলার টাকাই থাকেনা, মেজাজ হয়ে থাকে খিটখিটে। ছেলেটাকে অযথা অনেক বকাবকি করেন।

মিরাজ সাহেব সাজুকে জিজ্ঞাসা করেন, কিরে আর কিছু লাগবে তোর?
উহু।
তোর না রঙ পেন্সিল শেষ হয়ে গেছে। চল তোকে রঙ পেন্সিল কিনে দেই।
সাজু অবাক হয়ে ভাবতে থাকে তার রাগী বাবা হঠাৎ করে আজ অরুর বাবার মত এত ভালো বাবা হয়ে গেল কিভাবে! বল কিনে দিলো তারপর আবার রঙ পেন্সিল। কখন এই বল নিয়ে অরুকে দেখাবে , আর বন্ধুরা তাকে নিশ্চয়ই খেলায় নিবে। বাবার মুখের দিকে তাকাতেই আবার ভয় চলে আসে। কত দিন সবুজ রঙের গাছ আঁকার ইচ্ছে তার। কিন্তু গত মাসে স্কুলে টিফিনের সময় কে যেন পেন্সিল বক্স চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। এবার ব্যাগটা সব সময় কাছে রাখবে বলে ভাবতে থাকে সাজু।
সাজু কি খাবি?
কিছু খাব না বাবা।
ধুর তুই কি সব সময় আমাকে ভয় পাস? আমাকে তোর অনেক খারাপ বাবা মনে হয়?
সাজু ভয়ে ভয়ে বলে, না বাবা। কিরে কোণ আইসক্রিম খাবি?
হুম। মুখে হাসি ফিরে সাজুর।
তুই তো অনেক বোকারে সাজু। আইসক্রিমের প্যাকেটটা পর্যন্ত ঠিক মত খুলতে পারিস না। দে খুলে দেই।
আজ মিরাজ সাহেবের মনে আনন্দ ফিরে এসেছে। সাজু আইসক্রিম খেতে খেতে বাবার হাত ধরে বাসায় ফিরতে থাকে। আজ সাজুরও বড় আনন্দের দিন।

৬.স্যার কি এক ঘটনা ঘটে গেল,কিছুই বুঝলাম না, মন্ত্রী মহোদয়ের ডান হাত, হাত কচলাতে কচলাতে বলে চলেছে। মন্ত্রী সাহেব এক মনে চোখ বন্ধ করে সিগারেট টেনে চলেছেন। একটু দম নিয়ে বললেন, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বলেই রক্ষারে। জী স্যার, ধরা খাইলো তো খাইলো এমন জায়গায় খাইলো! ভাগ্যিস আপনি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন দিয়ে আগেই জানাইছিলেন। তারপরও তো হউরের পো সাংবাদিকরা হাজির। মন্ত্রী সাহেব এবার চোখ খুলে বললেন, মিডিয়ার অবস্থা এমন যে কেউ হাগলেও তার রিপোর্ট করতে হাজির। এত সাধ কইরা পিএস সালেক আর সিরাজের জন্য রান্না করে রাখাইলাম, কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি, এত গুলি টেকা লইয়া এমন জায়গায় কট খাইলো। যে কইরাই হোক আমার ইমেজ ফিরাই পাইতে হইবো। ড্রাইভার হেকমতের ব্যবস্থা করার পর একটু শান্তি লাগতেছে। স্যার কাল কিন্তু সংবাদ সম্মেলন আছে, বললো মন্ত্রীর ডান হাত।

সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বললেন, এ সব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এত বছর ধরে আমি রাজনীতি করি আমার গায়ে একটা ফুলের টোকাও পরে নাই। মন্ত্রনালয়ে দায়িত্ব নিয়ে আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেছিলাম। তাই এই অবস্থা! আমি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি, না পদত্যাগ করবো ক্যান? প্রধানমন্ত্রী যদি বলেন তবেই করবো। আমি নির্দোষ। সব ষড়যন্ত্র।

মিডিয়ার জ্বালায় তো আর বাঁচি না রে, ডান হাতকে বলেন মন্ত্রী। ডান হাত তার টাক মাথা চুলকাতে চুলকাতে চিন্তা কইরেন না স্যার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সাথে আলোচনা কইরা এমন ঘটনা ঘটায় দিমু, আপনের ইস্যু চাপা পইড়া যাইবো। আর তাইলে আপনে কাইল পদত্যাগ করবেন? মন্ত্রী বললেন, হুম! প্রধানমন্ত্রী গ্রিন সিগন্যাল দিসে, পদত্যাগ করলেও দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর ব্যবস্থা করবেন। এবার ডান হাত বললেন, চিন্তা করিয়েন না স্যার, মানীর মান এইভাবে যায় না। মিডিয়া, ব্লগ, ফেসবুকে আপনারে নিয়া যারছিল চিললাইতাছে ওরাও অফ যাইবো।

মন্ত্রী তার ডান হাতকে বললেন, প্রেসক্লাবে আমারে প্রধান অতিথি কইরা কোন লেখক মরছেনা তার স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা কর আর আমাগো সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠান কইরা আলোচনার বিষয় বস্তু রাখো ''বিরোধী দলের দেশ বিরোধী রাজনীতি ও এর মোকাবেলা''

ইমেজ ভালো মত ফিরা আসতেছে। একটা পেইড সাংবাদিক ডেকে মন্ত্রী সাহেবের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা হয়েছে। মন্ত্রী হাসি মুখে নিজের ইমেজ ক্লিন দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একসময় তিনি সফল ও হলেন ভাবমূর্তি ধরে রাখতে। মন্ত্রী মহোদয়ের জয় হোক।

৭.তোমার কাছ থেকে পাওয়া আমার প্রথম গিফটটা ছিল 'বাংলার মেলা' থেকে মেরুল রঙের একটা পাঞ্জাবী। উপলক্ষ পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখে এর আগে কখনো পাঞ্জাবী পরিনি কখনো। আর এরকম আচমকা গিফট পাওয়া ছিল আমার কল্পনার বাইরে। দুই ঈদ মিলিয়ে এক শার্টেই চালিয়ে দিতাম ঈদের দিনটা। বড় হবার পর বাবার কাছ থেকে ঈদ উপলক্ষে নতুন জামার বায়না করতাম না কখনোই। ঈদের আগের দিন বাবার সাথে যেতাম ঈদের ( রান্না-বান্নার) বাজার করতে। বাজার করা শেষ হতেই বাবার বেতন-বোনাস সব শেষ হয়ে যেত। বাজার হাতে নিয়ে বাসার পথে যেতেই বাবার চোখ-মুখ দেখলেই বুঝতাম সারা মাস কিভাবে চলবে তার চিন্তায় আমার বাবার মুখটা মলিন হয়ে থাকতো। ঈদে ছেলেকে কিছু কিনে দিতে হবে এই ব্যাপারে তার এতটা মনোযোগ কখনোই ছিল নাহ। আসলে আমি ঐ ভাবে কিছু চাইতাম না বলেই বাবা হয়তো তেমনটাই ভাবতেন। তাই বলে ছেলেকে কিছু দিতে বাবার মন যে সংকীর্ণ ছিল তেমনটাও কিন্তু নয়। ঈদের ঠিক আগের রাতে মায়ের পীড়াপীড়িতে বাবা বলতেন চল 'মিতালি বস্ত্রালয়ে' গিয়ে তোকে কিছু কিনে দেই। আমি রাগ হয়ে বলতাম, তুমি জানো না আমার স্ট্যান্ডার্ড! আমি যেসব কাপড় পরি তাকি এই মফস্বলে পাওয়া যায় নাকি! আমি আমার শপিং ঢাকা থেকেই করে এনেছি। ঈদের আগের রাতে বাপ-ছেলের পুরনো পাঞ্জাবী নিজে ইস্ত্রি করে সকালে বের হতাম নামাজ পড়তে।

তাই তোমার কাছ থেকে কোন গিফট পাওয়া আমার জন্য অষ্টম আশ্চর্যই ছিল। তারপর আরেক ঈদে তুমি আমাকে বললে তুমি ৫০০ টাকা ম্যানেজ করতে পারবা? আমি বললাম, হুম। দুজনের টাকা এক করে ১৪০০ টাকা দিয়ে 'টেক্সমার্ট' থেকে টিয়া কালারের একটা পাঞ্জাবী কিনে দিলে। আমি নিতেই চাই নি, কিন্তু তোমার কড়া দৃষ্টি আমাকে নিতে বাধ্য করলো বলা চলে। অথচ কোন সময়ই আমি তোমাকে সাধারন কিছুই উপহার দিতে পারিনি, আর পরবোই বা কেমন করে! বাসা থেকে যে টাকা আসতো তা দিয়ে মাসের প্রথম দশ দিন কোনমতে চলার পরেই শুরু হত টানাটানি। এরকম কত সময় গেছে বাস ভাড়াটা পর্যন্ত থাকতো না বলে শার্টের পকেটে টাকা জোর করে গুজে দিতে। আর তোমার সাথে যখন আমার দেখা হত তখন আমাকে দেখেই বলতে, এই শার্ট, জিন্স, জুতা আর সানগ্লাস কার কাছ থেকে ধার করে এনেছি! মিথ্যা করে বলতাম আমারই তো! তখন তুমি বলতে, উহু সত্য বোলো! লজ্জায় বলতাম বন্ধুরটা পরে এসেছি। শুনে জোরে হেসে বলতে, আল্লাহ কি তোমার আর্থিক অবস্থার সহসা কোন উন্নতি করবেনা? ফুটফাট দিয়ে তোমাকে নিয়ে হাঁটার সময় ভ্যানে টি-শার্ট, গেঞ্জি বিক্রি করতে দেখলেই বলতে, চল না তোমাকে কয়েকটা গেঞ্জি কিনে দেই। আমি বলতাম না না, লাগবে না। শুনে তুমি বলতে, কেন কম দামি আর ব্র্যান্ডের না বলে নিতে চায়না? ভ্যানের কাছে গিয়েই বলতে মামা ওর সাইজের গেঞ্জি দেখান তো!

সময়ের স্রোতে তুমিও কবে চলে গেলে আমার কাছ থেকে এইটুকু টের ও পাইনি। আজো তোমার দেয়া জামা গুলোই ধুয়ে, ইস্ত্রি করে পরে চলেছি। মোটামুটি সব গুলো জামারই রঙ মলিন হয়ে গেছে অনেক ব্যবহারে। আর আমার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন তেমনটাই রয়ে গেছে। আজকাল ফুটপাতের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় একদাম ১৫০ শুনলে তোমার কথা মনে পরে যায়। জানি না সীমানার ওপারের দেশটাতে তুমি কেমন আছো! নিশ্চয়ই খুব ভালো আছো। আমার মত একটা ছেলের তোমাকে বছর ঘুরে ফুটপাতে, কিংবা পরিচিত কোন জায়গায় গেলে তোমাকে মনে করে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে তোমার চেহারাটা মনে করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে!

৮.মারুফ, চিৎকার করে কাঁদতে পারছেনা। না পারছে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে। গ্রেফতার আতঙ্ক এড়াতে পালিয়ে আছে বন্ধুর চাচার বাড়িতে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা, উন্মত্ত আগুনে পুড়ে গেছে তার কলেজ ছাত্রাবাস। শ্রীকান্ত ব্লক থেকে পানি এনে আগুন নিভানোর ব্যর্থ চেষ্টাটাও করেছিলো। চোখ ভরা জল নিয়ে দেখছিল সবার চোখের সামনেই একে একে আগুনে পুড়ে কয়লা হচ্ছে হোস্টেলের শতবর্ষ প্রাচীন কড়ি কাঠ-বর্গা-ঢেউটিন-দরজা-জানালা। কষ্টের পয়সায় কেনা নতুন পিসি, কয়েকশো প্রিয় বইয়ের সংগ্রহ। আর নিজের লেখা একটা কবিতার ডাইরি। আগুন যেন গ্রাস করে নিচ্ছিল সব, তার সব। রাজাকারের বাচ্চাদের নিধনে নাকি লাগানো হয়েছে আগুন। কই জীবনে তো কোন দিন প্রিয় বইয়ের পাতা ছাড়া মন যায় নি লীগ কিংবা শিবিরের আড্ডায়। সবাই হাহাকার করছে প্রিয় কলেজ, ঐতিহ্য নিয়ে। মারুফের হাহাকার তো সব কিছু নিয়ে। সে তো আর কিছুই ছিল না। ছিল কেবল এক কবি। জীবনে লেখা ৭৬টি কবিতাই ছিল তার প্রাণ! কবিতা তো আর কোন ধাঁধা নয়, ছিল তার মত একটা ছেলের জীবনের সব ধাঁধার সমাধান। পুড়লো এমসি কলেজ আর ছাই হল নিতান্তই এক কবির কবিতার পাতা। কার আর কি হবে! পালিয়ে থাকবে? পুলিশ ধরলে শ্রীঘরে যাবে এক কবি? যার কাছে কবিতা ছিল চিত্রকল্পের আগ্নোৎসব, যা কিনা গ্রাস হয়ে গেল কিছু অমানুষের ধরিয়ে দেয়া আগুনে!হায় ঐতিহ্য! হায় আবেগানুভূতি! হায় সিলেটবাসীর গর্ব! হায় মানবতা! হায় সাম্প্রদায়িকতা! হায় অসুস্থ রাজনীতি! হায় এক নীরব কবির আর্তনাদ! তবে শিবির করাই শ্রেয় ছিল তার। তা না হলে ক্যান ছাই হয়ে যাবে নিরীহ এক কবির সব কিছু?

৯.শিরিন, কি কর? আশফাক জিজ্ঞেস করে।
এইতো স্কুলের বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতা দেখি।
তুমি ঘুমাবা কখন?
একটু পরই।

রমিজ ভাই কাল আসবে টাকা নিতে। অল্প কিছু ম্যানাজ হয়েছে। কি করে রমিজ ভাইকে সামাল দিবে চিন্তা করতে থাকে আশফাক। গতবার টাকা দিতে না পেরে সাত দিন সময় বাড়িয়েছিল, এবার মনে হয় আর সম্ভব নয়। ইলেক্ট্রিসিটি নেই, তার উপর প্রচণ্ড গরম। আর এর মধ্যেই কিনা শিরিন মোমবাতি জ্বালিয়ে বাচ্চাদের খাতা দেখছে! নাহ শিরিনের অনেক ধৈর্য।

শিরিন খাতা দেখা শেষ করে আশফাকের পাশে এসে বসে। তোমার টাকা ম্যানাজ হয়েছে?
নাহ!
তাইলে?
দেখি। আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করে দিবে।
কাল অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরো, ঘরে কোন বাজার নেই।
আচ্ছা।
ওহ! ভুলেই গেছি, তোমার জন্য ২টা সিগারেট এনেছিলাম। ধরো।
ওমা, তুমি দেখি গোল্ডলিফ আনছো। হুদাই ১০টা টাকা জলে ফেললা।
তুমি এখন কিসব কমদামি হলিউড সিগারেট খাও, তাও টাকার জন্য কিনো না। ভাবলাম খুব টেনশনে আছো ইদানীং। আর প্রায় রাতেই দেখি সিগারেটের জন্য খুব অস্থির হয়ে থাকো।
তুমি এত খারাপ কেন শিরিন? টাকা দিয়ে আমার জন্য বিষ কিনে এনেছো।
কি বললা তুমি? সিগারেট দাও। কাল ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে আসবো।

আশফাক হাসতে হাসতে সিগারেট ধরায়। মোমটা শেষ হয়ে নিভে গেছে। কি আশ্চর্য! আজ রাতে পূর্ণিমা নাকি? এতক্ষন খেয়ালই করেনি। বাইরে ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে আর সেই সাথে জানালার গ্রিলের ফাঁক গলে ঘরের মধ্যে ঢুকছে মায়াবী জোছনার আলো।

১০.চাকরিটা ফুয়াদের খুব খুব প্রয়োজন। পাওনাদারদের সংখ্যা এতই বেড়ে গেছে, নতুন কারো কাছে ধার পাবার আশা নেই। পরিচিত লোকজন ফুয়াদকে এড়িয়ে চলে আর ফুয়াদ এড়িয়ে চলে পাওনাদারদের। অনেকদিনের মুখ ভর্তি জঞ্জাল কোনমতে কেটে কুটে অর্ধ ইস্ত্রি করা শার্টটা ঢোলা প্যান্টটার সাথে ইন করে চাকরি নামক সোনার হরিণ পাবার অপেক্ষায় বসে আছে ওয়েটিং রুমে। ওয়েটিংরুম ভর্তি চাকরি প্রার্থীদের উৎকণ্ঠা কিংবা অস্থিরতাও যেন তাকে অস্থির করে তুলছে। প্রতিটা মিনিট যেন প্রতিটি ঘণ্টার মত লাগছে। চাকরিটা কোন মতে পেতেই হবে। তা নাহলে যে বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছেটাও মরে যাবে। আসার সময় মা বলেছিল, বাপ চিন্তা করিস না। এইবার চাকরিটা তোর হইবই। তোর বাপ কাইলকা তাহাজ্জুতের নামাজে তোর লাইগা মেলা কানছে। রুমে অপেক্ষমান চাকরি প্রার্থীদের পোশাকই যেন তাদের চেহারা বলে দিচ্ছিল। ফুয়াদ অবশ্য কারু মুখের দিকে তাকাচ্ছে না, চোখ চলে যাচ্ছে তাদের জুতা আর মোজার দিকে। জুতার অবস্থা তাদের আর্থিক অবস্থা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছিল। বাহ! কয়েকজন দেখি মোজাও পড়েনি। অনেকের আবার জুতার তলা প্রায় খোলা খোলা। ফুয়াদ মনে মনে হেসে চিন্তা করছিল ওর জুতার চারপাশে যে বড় বড় সেলাই দিয়ে জোড়াতালি দেয়া সেটা কি কেউ দেখছে! মৌখিক পরীক্ষায় কি জিজ্ঞেস করবে এই নিয়ে যেন ওর কোন মাথা ব্যথা নেই। ভাবনা শুধু একটাই, যে করে হোক চাকরিটা পেতে হবে। অনেক প্রার্থী দেরি করে উপস্থিত হচ্ছে আর ওয়েটিং রুমে ঢুকেই সবাইকে সালাম দিচ্ছে। ফুয়াদ এই ব্যাপারটাতে বেশ মজা পাচ্ছে, কারণ কেউই সালামের জবাব দিচ্ছে না। একমনে ফুয়াদ রুমের এসিটার দিকে তাকিয়ে আছে আর মাঝে মধ্যে ঘড়ির কাটা দেখছে। হঠাৎ একটা মেয়ে কণ্ঠের সালামের আওয়াজ শুনতে পেল। বুঝল নতুন চিড়িয়া ওয়েটিং রুমে এসেছে। কিন্তু মেয়ে কণ্ঠটা অনেক চেনা চেনা লাগছে। আচমকা ফুয়াদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে জয়িতা রুমে ঢুকে এক মনে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ফুয়াদ ১০ সেকেন্ড এর মত চিন্তা করলো। তারপর হাতে রাখা ফাইলটা নিয়ে বের হয়ে এলো। মনের একটি সত্তা বারবার বাঁধা দিচ্ছিল, তুই যাস না ফুয়াদ। এ কিছুই নয় এক ধ্বংস জয়িতা। এর জন্য তুই চাকরির পরীক্ষা না দিয়েই চলে যেতে পারিস না। এই চাকরিটা না পেলে তোর কি হবে একবার চিন্তা কর। আরও একবার ভেবে দেখ, এখনো সময় আছে ফিরে যা। লিফট দিয়ে নামতে নামতে ফুয়াদ বিড়বিড় করে বলতে থাকলো এই ধ্বংস জয়িতার সাথে ২০টা সেকেন্ড থাকাও অসম্ভব। গোল্লায় যাক চাকরি।

১১.অফিস ছুটি হতেই চারটা বেজে গেল। মাসের দশ তারিখে বেতন সাথে বোনাস পেয়ে বেশ খুশি জামান। ফার্মগেট থেকে বাবা-মা এর জন্য ঈদের পোশাক কিনল বেশ দেখে শুনে। এই রঙের শাড়ি মাকে দেয়ার অনেক দিনের ইচ্ছে। অবশেষে কিনতে পারে আজই যেন ঈদ ঈদ লাগছে জামানের। বাড়ি ভাড়ার টাকাটা আলাদা করে রাখা। সমস্যা হল গিয়ে বাস ধরা। এক ঘণ্টা ধরে বাসে ওঠার অনেক চেষ্টা করলো। বাস স্ট্যান্ড এলাকাটাই গিজ গিজ করছে অগনিত মানুষে। সবারই যেন ইফতারের আগে বাড়ি ফেরার তাড়া। ঘড়ি দেখল জামান, ইফতারের সময় হবার আর আধা ঘণ্টা বাকি। সিএনজি নিবে কি নিবে না এই চিন্তা করতে করতে ৪০ টাকায় রিকশা ঠিক করলো। রিকশায় উঠেও যেন শান্তি নেই। ভয়াবহ যানজট। বিজয় সরণী পার হতেই ২০ মিনিট চলে গেল, কিন্তু এরপর পুরো রাস্তাই ফাঁকা। আগারগাও আসতেই আজান শুনতে পেল। আচমকা একটা প্রাইভেট কার এসে রিকশা আটকে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো ৫জন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানি ব্যাগ, মোবাইল, সাথের ব্যাগ ছিনিয়ে চলে গেল। আশপাশ দিয়ে যে কয়টা রিকশা যাচ্ছিল, সব গুলোই যেন ঝড়ের বেগে চলে যেতে থাকলো। এর মধ্যে আজান শেষ হয়ে গেল। রিকশায় বসে পাথরের মত বোবা হয়ে গেল জামান। চোখ দিয়ে অবিরাম পানি বের হচ্ছে, শার্টের বোতাম খুলে মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে ফেলে।

১২.সময়টা এখন ঠিক কত মনে করতে পারছেনা শুভ্র। একটা রেল ক্রসিং এর দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ক্রসিং এর এপাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, আর অপরপাশে বাইক নিয়ে তার ছেলে বন্ধু। ছেলে বন্ধুটির চারপাশে বেশ কিছু মাস্তান টাইপ ছেলে ঘিরে আছে। একসময় তারা ছেলেটির উপর চড়াও হলো। এর মধ্যে কয়েকটি ছেলে আঙুল তুলে মেয়েটির দিকে দেখালো। আর ঠিক এই সময়ে ট্রেন চলে আসলো। তখন শুভ্রর হঠাৎ কি হল, মেয়েটিকে বাঁচাতে মেয়েটির হাতটি টেনে ধরে দুজনে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে আরম্ভ করলো। সামনে লাগোয়া দুটি বিল্ডিং দেখতে পেয়ে, গায়ের সব শক্তি দিয়ে মেয়েটিকে টেনে বিল্ডিং এর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলো। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠতে গিয়ে ওই ছেলেগুলো যেন তাদের দেখতে না পারে তার জন্য মাথা নিচু করে উঠতে থাকলো, কারণ বিল্ডিং এর সাইড মিরর দিয়ে নিচ থেকে সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে। মেয়েটিকে নিয়ে শুভ্র যখন প্রায় ছাদের কাছাকাছি চলে এসেছে, তখন নিচ থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা ছেলেগুলোর হুঙ্কার শুনতে পাচ্ছে। দুটো বিল্ডিং এর ছাদ লাগোয়া বিধায় শুভ্র মেয়েটিকে নিয়ে এক ছাদের প্রাচীর টপকে অন্য ছাদে চলে এলো। আর এর মধ্যেই ছেলেগুলো ছাদে চলে এসেছে।

কিন্তু নতুন ছাদে আসার পর যেন ছাদের চেহারাটা পাল্টে গেল। যে ছাদ একদম জনশূন্য ছিল, সে ছাদ এখন লোকে লোকারণ্য। কিন্তু সবাই খুব শৃঙ্খলার সাথে যার যার কাজ করছে। কেউ ধারালো ছুরি হাতে ছুরির ধার পরীক্ষা করছে। কেউ কাফনের কাপড়, আগরবাতি, গোলাপজল নিয়ে বসে আছে। কেউবা লাশ বহনকারী খাটিয়া নামাচ্ছে। শুভ্রর মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে রেল ক্রসিং এর সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং পালানো তাকে এই মৃত্যুর আয়োজনের সামনে নিয়ে এসেছে। যেখানে সবাই তার মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। আচমকা সাথের মেয়েটি উধাও হয়ে গেল। আতঙ্ক এং ভয় নিয়ে শুভ্রর ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল রাত ৪টা ১০ বাজে। ১০ মিনিট চলে গেল ভয় কাটছে না। ভয় কাটাতে অন্ধকারে প্যাকেট হাতড়ে সিগারেট ধরালো শুভ্র।

১৩.মোবাইল এ দ্রুত টাইপ করছে শান্ত, ''তোমাকে আমি জানিয়েছি আমি কোথায় আছি, এই আমি ফোন বন্ধ করলাম আর তুমি না আসা পর্যন্ত ওপেন করছিনা, শুনো তোমাকে না দেখে আমি আজ যাবো না। তোমার আসতে দেরি হলে কিন্তু আমারও যেতে দেরি হবে।'' ১ ঘণ্টার মত পেরিয়ে গেছে, শশী এখনো আসে নি। শান্ত চারপাশে খুঁজে বেড়াচ্ছে এই শশী এলো কিনা! নাহ! ওনার কোন পাত্তাই নাই। মার্কেটের সিঁড়িতে বসে শান্ত ভাবে, এত এত মেয়েকে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু শশীরকোন দেখাই নেই। ধুর চলেই যাবে কিনা। গায়ের জ্বরটা মনে হয় বাড়ছেই অথচ বেয়াদপটার দেখা নেই। আর ভাল্লাগতেছেনা, আর ১০ মিনিট বসবে বলে ঠিক করলো। নাহ কোন সম্ভাবনা নেই। থাক, আর ৫ মিনিট বসি, মনে মনে ভাবল শান্ত । অপেক্ষা করা এত কষ্টের কেন! এতই যখন দেখতে ইচ্ছা করেছে, হুমকি দিয়ে এখন না দেখেইবা কেমনে যাবে, ইজ্জত বলে একটা কথা আছে না! ফাজিলটার জন্য পারপেল কালারের শার্ট পরেছে অথচ আজকেই যেন দুনিয়ার যত ফাউল, ড্যাম পোলাপাইন গুলা এই কালারের শার্ট পরেছে। মেজাজটা পুরাই বিলা। মোবাইল টা অন করবে কিনা ভাবে শান্ত। নাহ অন করলেই তো সেই প্যানপ্যানানি টেক্সট। ওই এত দেখতে ইচ্ছা করে ক্যান তোর? শশী এসেই বলে। যাক, আপনের তাইলে সুমতি হইছে, সানগ্লাসটা খুলে বলে শান্ত। আপনের যেন পেইন না লাগে তাইতো আপনের বাড়ির সামনে আইছি। যদি কইতাম ধানমণ্ডি আসেন তাইলেই তো নখরা শুরু করতেন। খিদা লাগছে খুব। চলেন আপনারে বন রুটি দিয়া চা খাওয়া শিখাই, বলেই হাসতে থাকে শান্ত।

১৪.আপনার ডাক নামটা যেন কি? ম্যাক্স ফাগু, জামানের উত্তর। গত ২০মিনিট ধরে জামান, অধরা মেহজাবিন নামের একটা মেয়ের সামনে বসে আছে ধানমণ্ডির কজমোতে। এই মেয়েটির সাথেই ওর বিয়ের কথা চলছে। সদ্য এ-লেভেল পাস করা বিত্তশালী বাবার দু মেয়ের মধ্যে বড় অধরা। গুলশান-২ নম্বরে নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে, তার উপর পরিবারের সবাই আমেরিকার সিটিজেন। বিয়ের প্রস্তাবটা জামানের ছোট মামা এনেছে। মেয়েদের নাকি একজন ফ্রেস গ্র্যাজুয়েট এবং বোকাসোকা ছেলে লাগবে। বিয়ের পর সোজা ওয়াশিংটন। ছোট মামা ভেবেছেন, এক বছর ধরে বেকার থাকা একমাত্র ভাগিনাটার যদি একটা গতি হয়। জামানের বিশ্বাসই হয়নি বাবা এই বিয়েতে মত দিবেন। সারাজীবন সৎ জীবনযাপন করা মানুষটা অবেলায় ছেলেকে পাচার করে দেবেন! সাজিলার কথা বারবার মনে আসলেও অজানা কিছু হিসেব মেলাতেই যেন কজমোতে এসেছে জামান।

সিরিয়াসলি বলেন, অধরার তাৎক্ষণিক প্রশ্ন।
আমি সিরিয়াস।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি সিরিয়াস নন। আমি আসার পর থেকেই আপনাকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছি, অথচ আমার সম্পর্কে জানার আপনার কোন আগ্রহ নেই।

জামানের আসলেই কোন আগ্রহ নেই। অধরা বিত্তশালী বাবার মেয়ে ছাড়া আহামরি কিছুই নয়। শুরুতে জামান অনেক চেষ্টা করেছিলো এই মেয়েটিকে জোড় করে পছন্দ করার। এতো আর সাজিলা নয় যাকে প্রাণ খুলে শুনানো যাবে ‘হয়তো হাজার হাজার বছর পরে মাঘের নীল আকাশে সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাবো আমাদের মনে হবে হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম।’

আসলে এইভাবে বিয়ের জন্য আমি ঠিক প্রস্তুত না।
আপনার কোন ডিমান্ড আছে
না, আপনাদের সাথে মেরিকা যাবো এটাই যথেষ্ট।
প্রেম করেছেন?
হুম। ৩-৪টার মত করেছি, কাউকেই পরে আর ভালো লাগেনি।
কেন? আমি তো প্রায়ই গঞ্জিকা সেবন করি, আর গার্লফ্রেন্ডের উপর মেজাজ খারাপ হলে চড়-থাপ্পড় দিয়ে বসি। আর এক আইটেম বেশি দিন ভালো লাগেনা।
আপনি গাঁজা খান? এই গার্লফ্রেন্ডদের সাথে সেক্স করেছেন?
হুম, যখন ওদের বাসা খালি থাকতো ওরাই জানাতো। তখন সোজা বাসায় চলে যেতাম।
আপনি কি ফাইজলামি করছেন?
জামান এবার কপাল কুঁচকে বললো, আপনার কি তাই মনে হচ্ছে? দু দিন পর আপনি হবেন তুমি, মানে আমার লিগ্যাল ওয়াইফ। আপনার কাছে লুকাবো কেন?
ওকে। আজকে তাহলে যাই। বাপি আপনার সাথে পরে কথা বলবে।

বের হতে গিয়ে অধরা বেশ কবার হোঁচট খেল আর জামানের দিকে ফিরে তাকালো। একজনের চোখে বিস্ময় আর ভয় আর আরেকজনের চোখে সাজিলা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন