বাঘা বাণী
ঘ্যা... ঘ্যাউ, ঘ্যাউ ঘ্যাউ। চমকে গেলেন? কিছুই বুঝলেন না তাইনা?অনুভূতির একটা ধর্ম আছে। অচেনা কৌতূহল মনে চেনা অনুরন তুললে অনুভূতি বিরম্বনায় পরে। বড় অস্বস্তি লাগে। না, আর বিরক্ত করব না। শুরুতে বলেছিলাম,আমি আপনাকে যা বলছি বুঝছেন তো?
ঠিক কোথায় আমার জন্মটা হয়েছিল বলতে পারব না। মা বলেছিল, শাহবাগ থানার পাশে যে ফুলের দোকান গুলো আছে তার পিছনে আমি ভূমিষ্ট হয়েছি। বড় আরামের যায়গা। ফুল বিক্রেতারা অবিকৃত ফুল, মালা, তোরা এখানে ফেলে। আপনারা যা প্রিয় মানুষকে উপহার দাও আমি তার উপরেই মল ত্যাগ করি। রাগ করলেন? আহা!কিভাবে বুঝাব, আপনাদের বোধ আমার সাথে মিলবে না। এইত সেদিন ছবির হাটের গেট দিয়ে ঢোকার সময় চুলওয়ালা এক ভদ্রলোক আমার গায়ে গরম চা মারল। ব্যাথায় ককিয়ে উঠেছি, প্রচন্ড রাগও হয়েছিল। আপনাদের বোধ তাহলে কিরকম হবে? এই দেখ, হুজুগে একটু জ্ঞান দেওয়া শুরু করলাম। সরি! প্রিয়, যা বলছিলাম। আমরা প্রথমে এক বোন ও তিন ভাই ছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভাই দুটি উধাও হয়ে গেল। মা অনেক কেঁদে ছিল। কেটি কে নিলনা মেয়ে বলে, আর আমার গায়ে লোম ছিল না বলে বেঁচে গেছি। কেটিকে চিনছেনতো? আমার বোন। সেই শিশুকালে দুজন এক সাথে কত খেলেছি!শাহবাগের ধূলোমাটি গায়ে মাখার দায়ে দুজনকেই মা শাসিয়ে ছিল, ঘ্যাও ঘ্যাও বলে। ধিরে ধিরে কেটে গেল মায়ার বন্ধন। এক সকালে মা সেই যে চলে গেল, আর ফিরল না। অনেক ঘুরেছিলাম সোহরাওয়ার্দী, রমনার মাঠে। পিজি হাসপাতাল কিংবা বারডেমের সামনে, যেখানে ঠায় বসে থাকত সারা বিকেল। কোথাও খুঁজে পাইনি। শেষে আশা ছেড়ে দিয়ে পথে নেমেছি। কেটির জন্য প্রথম প্রথম খাবার নিতাম। পরে সে নিজেই তার পথ বেছে নিয়েছে।
মনিষীদের ঐ বানী টা আমার জীবন থেকে দেখেছি, “পথ পথিককে নয়, পথিকই পথের সৃষ্টি করে”। পথ যতই দুর্গম হোক ওটাতে বিচরন হবেই। যেমন তোমরা জলে-স্থলে কিংবা বায়ু পথে সর্বত্রই ঘুরে বেড়াও। কোথাও কি বাধা পাও? ঐ যে ‘প্রয়োজনীতা উদ্ভাবনের জনক। আবার তত্ত্ব কথা শুরু হয়ে গেল। যাই হোক আমার কিশোর বেলায় যখন চারুকলার বারান্দায়, টিএসসি’র মোরে একা একা দিব্যি ঘুরে বেড়াই বেশ ভালই লাগে। বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করেছি চিকন ভ্রু’র কিছুটা বেটে মেয়েটি সকালে এক যুবকের সাথে আবার, আরেক ভদ্রলোকের সাথে আবার রাতে অন্য কারও গাড়িতে কোথায় যেন যায়। কয়েকদিন ধরে মেয়েটিকে না দেখে ওদের বাসার সামনে যাই। তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছে। কি আর করা, বাসার সামনে কিছু ময়লা জমে ছিল ওগুলো সরিয়ে দিয়েছি। মেয়েটির উপরে আমার মায়ার অন্য একটা কারন আছে। আমার অতি প্রিয় বন্ধুর সাথে ওর দারুন সখ্যতা। অবাক হলেন? ভাবেছেন আমার আবার বন্ধু জুটল কি করে? সে এক বিচিত্র কাহিনী।
এক শীতের রাতে যখন প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি, কুয়াশার ঘোরে খচ খচ আওয়াজ পাচ্ছি। জানেনইতো আমার শ্রাব্যতার সীমা প্রায় ৩৫০০০ হার্জ। শুয়েছিলাম শিখা চিরন্তনের পাশে। ছবির হাট থেকেই শব্দটা আসছে। কেন যেন ঘেউ বলে সতর্ক করলাম না। লেজ নাড়তে নাড়তে কাছে গেলাম। বড় বড় চুলের পাঞ্জাবী পড়া এক তরুণ, বেশ বড় গোঁফ। বয়সের সাথে মোটেও মানানসই না। আমি আবার চুল ওয়ালাদের দেখতে পারিনা। সেদিন আমার গায়ে গরম চা মেরেছিল একজন। তবু কিছু বললাম না। দেখি ব্যাটা কি করে। আমার দিকে তাকিয়েই একটা মুচকি হাসি। কিরে ঘুমাসনি? তুই কি আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলি? চল গল্প করি বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ব্যাগ থেকে পাউরুটির গন্ধ পেলাম। পিছে পিছে হাঁটতে লাগলাম। লালন চর্চা কেন্দ্রে গিয়ে পাশে বসলাম। ব্যাগ থেকে রুটি বের করে কিছুটা দিল, নিজেও কিছুটা খেল। একটা খাতা বের করে কিছুক্ষন কি যেন লিখল। তার পর ঘুমিয়ে গেল। আপনারা বড়ই বিচিত্র জীব। ঘুমের জন্য বাসা বাড়ি আছে, বস্তি আছে, হোটেল আছে যান সেখানে যান। তা না করে পার্কে, ফুটপাতে, মাঠে যেখানে সেখানে খাওয়া ঘুম। অবশ্য সবাই যে এরকম ঠিক তা নয়। তবে এভাবে এরা কেন থাকে আমার মাথায় ধরে না।
প্রতিদিনকার মত সকাল হল। আজকের সকালটা কেন যেন মনে হচ্ছে আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ট প্রাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। জীবনে ভালবাসা খুব একটা বেশী পাইনি। বাবাকেতো কোনদিন দেখিনি, মাও চলে গেল অবেলায়। শুনেছি কার্তিকের এক দুপুরে মস্তিষ্ক বিকৃতির অপরাধে মানুষ তাকে মেরে ফেলেছে। যাক, এ বেলা এই নাবালক কবিকে পেয়ে ভালই লাগছে। ভাল লাগাটা ঠিক কতক্ষণ স্থায়ী হয় বলতে পারছি না। তবে এর হাঁটার গতি দেখে নিজেই অবাক হয়েছি। সেই সকাল থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত অবিরাম হেঁটে চলা। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটার পর একটা সিজার সিগারেট জ্বালিয়ে যাচ্ছে। হায় হায়, এভাবে সিগারেট খেলে আমাদের বন্ধুত্বের অবসান তো দেখছি অনিবার্য। কতদিন বেঁচে থাকবে এভাবে। ঘেউ ঘেউ... হারামজাদা বজ্জাত রিকশাওয়ালা। আরেকটু হলেই বন্ধুর গায়ে তুলে দিচ্ছিল। মাতাল কোথাকার। আবার হাঁটা, এবার গন্তব্য শিল্পকলার দিকে। এরপর এভাবে কেটে গেল পুরো শীতকাল। মৈত্রীটা কুয়াশার মত কেটে গেল কিনা বুঝলাম না। আগের মত আর হাসে না বন্ধু। কেমন ছল ছল তাকিয়ে থাকে আমার লেজের দিকে। বটের ছায়ায় বসে তোমরা যেমন তাকাও মধ্যান্নের রোদে, হেলে পরার মানসে। অজানা আশঙ্কায় মনটা কেঁপে ওঠে। আসলে আমাকে ভালবাসে খুব, ঠিক তার কবিতার মত। ইদানিং আমাকে কখও চোখের আড়াল করে না। রাতে ঘুমানোর আগে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর কি যেন বিড়বিড় করে। আহারে! আমার যদি হাত থাকত সারারাত পাখার বাতাস দিতাম। শত ক্লান্তির পরেও যখন আমাকে বাঘা বলে ডাকে সব ছেড়ে দিয়ে ছুটে আসি। আমার এই বাঘা নাম দেয়ার কারনে আমি মোটেও খুশী নই। গ্রাম্য প্রবাদের মত হয়ে গেল না? ‘ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম’। আবার আমি যত নিষেধ করলাম, এই লেখার শিরোনাম বাঘাবানী না দিয়ে বাঘাবমী দাও। কে বোঝে কার কথা! যাক, ঐ আঁতেলের কথা বাদ দিন তো।
আজ বৃহস্পতি বার, লালন ভক্তদের গুরুবার। সন্ধ্যা থেকে নানান ধর্মের,মতের মানুষের সমাগম হয় প্রিয় ধামে। আমার ওখানে যাওয়া নিষেধ তাই কবি মনে ক্ষোভের অন্ত নাই। এর জন্য বহু কাথা শুনতে হয়েছে তাকে। আমিও অবেলায় বিরক্ত করিনা। থাকনা কিছুটা সময় নিজের মাঝে, আত্মার সান্নিধ্যে। লালনের দেহ্তত্ত্ব, আত্মাতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব গান গুলো আমারও ভাল লাগে। ভাল লাগে একতারার ঐক্যতান। তোমাদের মাঝে যেমন শাসনতন্ত্র আছে শোসণতন্ত্রের অবয়বে আমাদের মাঝেও তেমন আছে মনতন্ত্র। আমরা আমাদের জাতিকে নয় মনতন্ত্রে নিজেকে শাসন করি। এতেই সমাজ সুশৃঙ্খল আমাদের। নিজেদের প্রশংসা আর না করলাম। কবির সকাল থেকেই মন খারাপ। সরকার ঘোসনা দিয়েছে পাগলা কুকুর নিধনের। পুলিশের অভিযান শুধু পাগলা কুকুরেই সীমাবদ্ধ নয়, পথে ঘাটে কুকুর পেলেই হল। সোহরাওয়ার্দীর মাঠে শিখা চিরন্তনের পাশে বড় ওয়ালের ভিতরে যে ঘর ওটার মাঝে আমাকে একটা রুটি দিয়ে কবি বলল এখানে থাক আজ। কোথাও যেতে হবে না। ভিতরে ভিতরে রাজী না হলেও রুটির লোভে থেকে গেলাম। এটাই আমাদের স্বভাব। খাবার পেলে প্রভুর কথা ভুলে যাই। লালনের ঐ গানটার মত,
“গুরু কার্য মাথায় নিয়ে কি করি আর কোথায় যাই
রাত পোহালে পাখি বলে দেরে খাই দেরে খাই”
খাবার শেষ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তোমাদের সাথে আমাদের বড় পার্থক্য কি জান? তোমরা যেমন শান্ত স্বভাবের আমারা তার বিপরীত। চঞ্চলতা আমাদের একটা মুদ্রা দোষ। বন্ধু একা একা লালন চর্চা কেন্দ্রে। আবার আজ ওখানে শিরনী বিতরন হবে সেই লোভ সামলাতে না পেরে এক পা দু’পা করে ধামের দিকে যেতে লাগলাম। একটা গান ভেসে আসছিল, ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়’। ষষ্ঠইন্দ্রিয় কেমন যেন বিপদের আভাস দিচ্ছে। বন্ধুর কোন বিপদ নাতো? ধামের দিকে দৌড় দিতে যাব অমনি ঠাস!
কার্তিকের পলাশ আশ্বিনেই ঝরে গেল। হলদে বর্ণের ইটের রং লালচে হল ঝাঝালো বুলেটে। চোখটা কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সাথে সাথে। একটা তারাকে জ্বলতে জ্বলতে নিভে যেতে দেখলাম। মৃত্যুক্ষুধায় কি তারাও নিভে যায়?তবু আবছা আলো কিছুক্ষণ খুঁজল চুলওয়ালা বন্ধুর একফোঁটা চোখের জল। এরপর কত অমাবশ্যা গেল কত পূর্ণিমার পেছনে পেছনে। কই কখনও তাদের দেখা হয়েছে কি?শুধু বাতাসের মুখে একদিন শুনেছিলাম কবি বন্ধুর ‘বাঘা’ কাব্যের দীর্ঘশ্বাস।‘নীল পদাবলীর’ নীল তরঙ্গে মিশে গেছে সে সুর। আপন কণ্ঠে বেজে চলে সে অনুরক্ত অনুরন,
‘ঘ্যাউ... ঘ্যা, ঘ্যা ঘ্যা, ঘ্যা ঘ্যাউ,
ঘ্যাউ, ঘ্যাউ, ঘ্যাউ’।
ঘ্যা... ঘ্যাউ, ঘ্যাউ ঘ্যাউ। চমকে গেলেন? কিছুই বুঝলেন না তাইনা?অনুভূতির একটা ধর্ম আছে। অচেনা কৌতূহল মনে চেনা অনুরন তুললে অনুভূতি বিরম্বনায় পরে। বড় অস্বস্তি লাগে। না, আর বিরক্ত করব না। শুরুতে বলেছিলাম,আমি আপনাকে যা বলছি বুঝছেন তো?
ঠিক কোথায় আমার জন্মটা হয়েছিল বলতে পারব না। মা বলেছিল, শাহবাগ থানার পাশে যে ফুলের দোকান গুলো আছে তার পিছনে আমি ভূমিষ্ট হয়েছি। বড় আরামের যায়গা। ফুল বিক্রেতারা অবিকৃত ফুল, মালা, তোরা এখানে ফেলে। আপনারা যা প্রিয় মানুষকে উপহার দাও আমি তার উপরেই মল ত্যাগ করি। রাগ করলেন? আহা!কিভাবে বুঝাব, আপনাদের বোধ আমার সাথে মিলবে না। এইত সেদিন ছবির হাটের গেট দিয়ে ঢোকার সময় চুলওয়ালা এক ভদ্রলোক আমার গায়ে গরম চা মারল। ব্যাথায় ককিয়ে উঠেছি, প্রচন্ড রাগও হয়েছিল। আপনাদের বোধ তাহলে কিরকম হবে? এই দেখ, হুজুগে একটু জ্ঞান দেওয়া শুরু করলাম। সরি! প্রিয়, যা বলছিলাম। আমরা প্রথমে এক বোন ও তিন ভাই ছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভাই দুটি উধাও হয়ে গেল। মা অনেক কেঁদে ছিল। কেটি কে নিলনা মেয়ে বলে, আর আমার গায়ে লোম ছিল না বলে বেঁচে গেছি। কেটিকে চিনছেনতো? আমার বোন। সেই শিশুকালে দুজন এক সাথে কত খেলেছি!শাহবাগের ধূলোমাটি গায়ে মাখার দায়ে দুজনকেই মা শাসিয়ে ছিল, ঘ্যাও ঘ্যাও বলে। ধিরে ধিরে কেটে গেল মায়ার বন্ধন। এক সকালে মা সেই যে চলে গেল, আর ফিরল না। অনেক ঘুরেছিলাম সোহরাওয়ার্দী, রমনার মাঠে। পিজি হাসপাতাল কিংবা বারডেমের সামনে, যেখানে ঠায় বসে থাকত সারা বিকেল। কোথাও খুঁজে পাইনি। শেষে আশা ছেড়ে দিয়ে পথে নেমেছি। কেটির জন্য প্রথম প্রথম খাবার নিতাম। পরে সে নিজেই তার পথ বেছে নিয়েছে।
মনিষীদের ঐ বানী টা আমার জীবন থেকে দেখেছি, “পথ পথিককে নয়, পথিকই পথের সৃষ্টি করে”। পথ যতই দুর্গম হোক ওটাতে বিচরন হবেই। যেমন তোমরা জলে-স্থলে কিংবা বায়ু পথে সর্বত্রই ঘুরে বেড়াও। কোথাও কি বাধা পাও? ঐ যে ‘প্রয়োজনীতা উদ্ভাবনের জনক। আবার তত্ত্ব কথা শুরু হয়ে গেল। যাই হোক আমার কিশোর বেলায় যখন চারুকলার বারান্দায়, টিএসসি’র মোরে একা একা দিব্যি ঘুরে বেড়াই বেশ ভালই লাগে। বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করেছি চিকন ভ্রু’র কিছুটা বেটে মেয়েটি সকালে এক যুবকের সাথে আবার, আরেক ভদ্রলোকের সাথে আবার রাতে অন্য কারও গাড়িতে কোথায় যেন যায়। কয়েকদিন ধরে মেয়েটিকে না দেখে ওদের বাসার সামনে যাই। তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছে। কি আর করা, বাসার সামনে কিছু ময়লা জমে ছিল ওগুলো সরিয়ে দিয়েছি। মেয়েটির উপরে আমার মায়ার অন্য একটা কারন আছে। আমার অতি প্রিয় বন্ধুর সাথে ওর দারুন সখ্যতা। অবাক হলেন? ভাবেছেন আমার আবার বন্ধু জুটল কি করে? সে এক বিচিত্র কাহিনী।
এক শীতের রাতে যখন প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি, কুয়াশার ঘোরে খচ খচ আওয়াজ পাচ্ছি। জানেনইতো আমার শ্রাব্যতার সীমা প্রায় ৩৫০০০ হার্জ। শুয়েছিলাম শিখা চিরন্তনের পাশে। ছবির হাট থেকেই শব্দটা আসছে। কেন যেন ঘেউ বলে সতর্ক করলাম না। লেজ নাড়তে নাড়তে কাছে গেলাম। বড় বড় চুলের পাঞ্জাবী পড়া এক তরুণ, বেশ বড় গোঁফ। বয়সের সাথে মোটেও মানানসই না। আমি আবার চুল ওয়ালাদের দেখতে পারিনা। সেদিন আমার গায়ে গরম চা মেরেছিল একজন। তবু কিছু বললাম না। দেখি ব্যাটা কি করে। আমার দিকে তাকিয়েই একটা মুচকি হাসি। কিরে ঘুমাসনি? তুই কি আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলি? চল গল্প করি বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ব্যাগ থেকে পাউরুটির গন্ধ পেলাম। পিছে পিছে হাঁটতে লাগলাম। লালন চর্চা কেন্দ্রে গিয়ে পাশে বসলাম। ব্যাগ থেকে রুটি বের করে কিছুটা দিল, নিজেও কিছুটা খেল। একটা খাতা বের করে কিছুক্ষন কি যেন লিখল। তার পর ঘুমিয়ে গেল। আপনারা বড়ই বিচিত্র জীব। ঘুমের জন্য বাসা বাড়ি আছে, বস্তি আছে, হোটেল আছে যান সেখানে যান। তা না করে পার্কে, ফুটপাতে, মাঠে যেখানে সেখানে খাওয়া ঘুম। অবশ্য সবাই যে এরকম ঠিক তা নয়। তবে এভাবে এরা কেন থাকে আমার মাথায় ধরে না।
প্রতিদিনকার মত সকাল হল। আজকের সকালটা কেন যেন মনে হচ্ছে আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ট প্রাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। জীবনে ভালবাসা খুব একটা বেশী পাইনি। বাবাকেতো কোনদিন দেখিনি, মাও চলে গেল অবেলায়। শুনেছি কার্তিকের এক দুপুরে মস্তিষ্ক বিকৃতির অপরাধে মানুষ তাকে মেরে ফেলেছে। যাক, এ বেলা এই নাবালক কবিকে পেয়ে ভালই লাগছে। ভাল লাগাটা ঠিক কতক্ষণ স্থায়ী হয় বলতে পারছি না। তবে এর হাঁটার গতি দেখে নিজেই অবাক হয়েছি। সেই সকাল থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত অবিরাম হেঁটে চলা। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটার পর একটা সিজার সিগারেট জ্বালিয়ে যাচ্ছে। হায় হায়, এভাবে সিগারেট খেলে আমাদের বন্ধুত্বের অবসান তো দেখছি অনিবার্য। কতদিন বেঁচে থাকবে এভাবে। ঘেউ ঘেউ... হারামজাদা বজ্জাত রিকশাওয়ালা। আরেকটু হলেই বন্ধুর গায়ে তুলে দিচ্ছিল। মাতাল কোথাকার। আবার হাঁটা, এবার গন্তব্য শিল্পকলার দিকে। এরপর এভাবে কেটে গেল পুরো শীতকাল। মৈত্রীটা কুয়াশার মত কেটে গেল কিনা বুঝলাম না। আগের মত আর হাসে না বন্ধু। কেমন ছল ছল তাকিয়ে থাকে আমার লেজের দিকে। বটের ছায়ায় বসে তোমরা যেমন তাকাও মধ্যান্নের রোদে, হেলে পরার মানসে। অজানা আশঙ্কায় মনটা কেঁপে ওঠে। আসলে আমাকে ভালবাসে খুব, ঠিক তার কবিতার মত। ইদানিং আমাকে কখও চোখের আড়াল করে না। রাতে ঘুমানোর আগে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর কি যেন বিড়বিড় করে। আহারে! আমার যদি হাত থাকত সারারাত পাখার বাতাস দিতাম। শত ক্লান্তির পরেও যখন আমাকে বাঘা বলে ডাকে সব ছেড়ে দিয়ে ছুটে আসি। আমার এই বাঘা নাম দেয়ার কারনে আমি মোটেও খুশী নই। গ্রাম্য প্রবাদের মত হয়ে গেল না? ‘ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম’। আবার আমি যত নিষেধ করলাম, এই লেখার শিরোনাম বাঘাবানী না দিয়ে বাঘাবমী দাও। কে বোঝে কার কথা! যাক, ঐ আঁতেলের কথা বাদ দিন তো।
আজ বৃহস্পতি বার, লালন ভক্তদের গুরুবার। সন্ধ্যা থেকে নানান ধর্মের,মতের মানুষের সমাগম হয় প্রিয় ধামে। আমার ওখানে যাওয়া নিষেধ তাই কবি মনে ক্ষোভের অন্ত নাই। এর জন্য বহু কাথা শুনতে হয়েছে তাকে। আমিও অবেলায় বিরক্ত করিনা। থাকনা কিছুটা সময় নিজের মাঝে, আত্মার সান্নিধ্যে। লালনের দেহ্তত্ত্ব, আত্মাতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব গান গুলো আমারও ভাল লাগে। ভাল লাগে একতারার ঐক্যতান। তোমাদের মাঝে যেমন শাসনতন্ত্র আছে শোসণতন্ত্রের অবয়বে আমাদের মাঝেও তেমন আছে মনতন্ত্র। আমরা আমাদের জাতিকে নয় মনতন্ত্রে নিজেকে শাসন করি। এতেই সমাজ সুশৃঙ্খল আমাদের। নিজেদের প্রশংসা আর না করলাম। কবির সকাল থেকেই মন খারাপ। সরকার ঘোসনা দিয়েছে পাগলা কুকুর নিধনের। পুলিশের অভিযান শুধু পাগলা কুকুরেই সীমাবদ্ধ নয়, পথে ঘাটে কুকুর পেলেই হল। সোহরাওয়ার্দীর মাঠে শিখা চিরন্তনের পাশে বড় ওয়ালের ভিতরে যে ঘর ওটার মাঝে আমাকে একটা রুটি দিয়ে কবি বলল এখানে থাক আজ। কোথাও যেতে হবে না। ভিতরে ভিতরে রাজী না হলেও রুটির লোভে থেকে গেলাম। এটাই আমাদের স্বভাব। খাবার পেলে প্রভুর কথা ভুলে যাই। লালনের ঐ গানটার মত,
“গুরু কার্য মাথায় নিয়ে কি করি আর কোথায় যাই
রাত পোহালে পাখি বলে দেরে খাই দেরে খাই”
খাবার শেষ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তোমাদের সাথে আমাদের বড় পার্থক্য কি জান? তোমরা যেমন শান্ত স্বভাবের আমারা তার বিপরীত। চঞ্চলতা আমাদের একটা মুদ্রা দোষ। বন্ধু একা একা লালন চর্চা কেন্দ্রে। আবার আজ ওখানে শিরনী বিতরন হবে সেই লোভ সামলাতে না পেরে এক পা দু’পা করে ধামের দিকে যেতে লাগলাম। একটা গান ভেসে আসছিল, ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়’। ষষ্ঠইন্দ্রিয় কেমন যেন বিপদের আভাস দিচ্ছে। বন্ধুর কোন বিপদ নাতো? ধামের দিকে দৌড় দিতে যাব অমনি ঠাস!
কার্তিকের পলাশ আশ্বিনেই ঝরে গেল। হলদে বর্ণের ইটের রং লালচে হল ঝাঝালো বুলেটে। চোখটা কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সাথে সাথে। একটা তারাকে জ্বলতে জ্বলতে নিভে যেতে দেখলাম। মৃত্যুক্ষুধায় কি তারাও নিভে যায়?তবু আবছা আলো কিছুক্ষণ খুঁজল চুলওয়ালা বন্ধুর একফোঁটা চোখের জল। এরপর কত অমাবশ্যা গেল কত পূর্ণিমার পেছনে পেছনে। কই কখনও তাদের দেখা হয়েছে কি?শুধু বাতাসের মুখে একদিন শুনেছিলাম কবি বন্ধুর ‘বাঘা’ কাব্যের দীর্ঘশ্বাস।‘নীল পদাবলীর’ নীল তরঙ্গে মিশে গেছে সে সুর। আপন কণ্ঠে বেজে চলে সে অনুরক্ত অনুরন,
‘ঘ্যাউ... ঘ্যা, ঘ্যা ঘ্যা, ঘ্যা ঘ্যাউ,
ঘ্যাউ, ঘ্যাউ, ঘ্যাউ’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন