৩১ অক্টোবর ২০১২

সিনমিন ইয়াসমিন

দোলনচাঁপা

মেয়েদের বাড়ির প্রতি টান বেশি থাকে কারন তারা জানে যে চাইলেও চিরদিন বাড়িতে থাকতে পারবে না এক সময় না এক সময় পরের ঘরে যেতেই হবে ছেলেদের যেহেতু পরের ঘরে যাওয়া জাতীয় কোন ভয় থাকেনা তাই তাদের স্বাভাবিক ভাবেই ঘরের প্রতি টানটা কম থাকে এখানে অবশ্য কারো কোন দোষ নেই , সৃষ্টি কর্তা উভয়কেই সৃষ্টি করে দিয়েছেন এমন করে এটা প্রকৃতির নিয়ম

সেই নিয়মের অংশ হিসেবেই এখন আমার বুক ফেটে কান্না আসছে কারন কিছুক্ষণ আগেই আমি আমার নিজের বাড়ি ছেড়ে এসেছি আজকে থেকে আমাকে থাকতে হবে অচেনা একটা পরিবেশে অচেনা কারন আমি আজই প্রথম এই বাড়িতে এলাম মানুষগুলো আমার আপনজন কিন্তু এখনও আমি কাউকে ঠিক মতো চিনিনা চেনার সুযোগটাই পাইনি কেমন করে জানি সব কিছু খুব দ্রুত হয়ে গেলো

একের পর এক লোকজন আসছে আমাকে দেখতে ছবির জন্য পোজ দিতে দিতে আমি কাহিল হয়ে গেছি নিজেকে চিড়িয়াখানার কোন প্রাণী মনে হচ্ছে মানুষজন খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছে আমাকে , নানান প্রশ্ন করছে তবে সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারটা আমাকে বিব্রত করছে সেটা হল বেশীর ভাগ লোকের কথাই আমি বুজতে পারছিনাকারন ওরা কথা বলছে একটা আঞ্চলিক ভাষায় এই ভাষাটা এখনও আমি ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারিনি মনে হয় কিছুটা সময় লাগবে আমার কারণ আমি ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে অভ্যস্ত আমার আশে পাশেও তাই এই কারনেই এখন আমার মনে হচ্ছে যেন মঙ্গল গ্রহে চলে এসেছি তবে শান্তি লাগছে এই দেখে যে মানুষটা আমাকে যথাসম্ভব আগলে রাখার চেষ্টা করছে বেশির ভাগ কথার জবাব মানুষটাই দিচ্ছে কেউ কেউ এটা নিয়ে ঠাট্টাও করছে যে এখনই এত বউ পাগল পরে কি হবে

পরে কি হবে আমি নিজেও জানি না আমাদের বিয়েটা একদমই পারিবারিকভাবে হয়েছে আমরা দুজন দুজনকে তেমন একটা জানার সুযোগই পাই নি তবে এ বাড়িতে আসার পর থেকে ও আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যায়নি , আশেপাশেই আছে ওই মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুটা ভরসা পাচ্ছি তবে এই মুহূর্তে বাড়ির কথা খুব মনে পরছে বাড়ির বাইরে থেকেছি আমি খুব কমই এক দিন থাকতেই আমার অস্থির লাগতো এখনত এটা ভেবে আরও বেশি অস্থির লাগছে যে এখন থেকে এখানেই থাকতে হবে কান্না আসছে খুব কিন্তু কাঁদতে পারছিনা

প্রথম যে দিন আমি বাসার বাইরে থেকেছিলাম সেটা হচ্ছে আমার ভার্সিটির হল  লাইফ এর প্রথম রাত বাসার জন্য এত মন খারাপ লাগছিল যে সারাটা রাত বারান্দায় দাড়িয়ে কেঁদেছি পরদিন সকাল হতেই বাড়ি চলে গেছি এ নিয়ে বন্ধুরা এখনও অনেক হাসাহাসি করে হাসাহাসি করলেই বা আমার কি যায় আসে , আমি থাকতে পারিনা তো এখন কি করব ? ৬ মাস অনেক কষ্টে থাকার পর আমি আবার বাসায় চলে গিয়েছিলাম একদম সব কিছু নিয়ে এর পর থেকে প্রতিদিন অনেকটা পথ বাস জার্নি করে ক্লাস করতাম কিন্তু এখন কি করবো ? এখনত চাইলেও আর যেতে পারবনা সারাজীবনের জন্য বাঁধা পরে গেলাম...

ভাবী , চলো ...

ভাবতে ভাবতে একদম নিজের মাঝে ডুবে গিয়েছিলাম মেয়েটা যে আমাকেই ডাকছে বুজতে পারছিলামনা না বুঝার অবশ্য আরও একটা কারন আছে এখন পর্যন্ত অনেক ডাক ই শুনেছি কিন্তু ভাবী ডাকটা এই বাড়িতে আসার পর থেকে শুনছি তাই এখনও ঠিক অভ্যস্ত হতে পারিনি

কই... এসো...

আমি উঠে দাঁড়ালাম মনে হল যেন অনন্তকাল ধরে বসে ছিলাম পা এ ঝি ঝি ধরে গেছে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলাম কোথায় যাচ্ছি বুজতে পারছিনা মানুষটাকেও আশেপাশে কোথাও দেখছিনা অনেক বাঁধাবিপত্তি পেড়িয়ে দোতলায় এলাম বাড়িটা বেশ সুন্দর পছন্দ হয়েছে আমার যে ঘরটায়টায় আমরা এলাম খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেলো...

এটা তোমার ঘর , পছন্দ হয়েছে ?

আমি তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম এর মানে পছন্দ হয়েছে

এখানে সব কিছু দেয়া আছে , তুমি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমার উপর দিয়ে আর কেউ বিরক্ত করবে না আমি ভাইয়া কে পাঠিয়ে দিচ্ছি

শেস কথাটা বলার সময় দেখলাম ওর চোখে দুষ্টমি খেলা করছে

আমি ঘরটা ভাল করে দেখতে লাগলাম জানালার পাশে গেলাম বন্ধ ছিল কারন ঘরে এসি চলছে জানালাটা খুলতেই একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে গাঁয়ে লাগলো মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছে ইসশ... খুব ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে মানুষটা যদি থাকতো বলে দেখা যেত কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেলো এখনও দেখা নেই

ঠাণ্ডা পানির নিচে দাড়িয়ে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিলাম গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরে এলামঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় ২ টা বাজতে চললো , এখনও এলো না ? ঘুম আসছে আমার খুব কিন্তু মানুষটা কে রেখে ঘুমিয়ে পরবো ? মন সায় দিচ্ছেনা একটা বই নিয়ে সোফায় যেয়ে আধ-শোয়া হয়ে বসলাম

 

মনে হল অনন্ত কাল পর সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কেন জানি হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে বসলো আমাকে আমি উঠে বসলাম সাথে সাথেই দরজা খুলে গেলো আমি কেঁপে উঠলাম , ব্যাপারটা মানুষটার চোখ এরায়নি

আরে আরে , তুমি এমন কাঁপছ কেন রিল্যাক্স এন্ড সরি , দেরি হয়ে গেল তোমাকে অনেক্ষন একা থাকতে হল

আমি স্বাভাবিক ভাবে হাসার চেষ্টা করলাম না , ঠিক আছে , কোন সমস্যা হয়নিবইটা পড়তে পড়তেই সময় কেটে গেছে

আসলে তোমার কারনেই একটু দেড়ি হয়ে গেলো

আমার কারনে ? বলে কি এই ছেলে , আমি আবার কি করলাম ?

 আমার কারনে দেড়ি হল , আসলে ব্যাপারটা ঠিক বুজলাম না একটু বুঝিয়ে বলুনতো

বলার চেয়ে দেখালেই বেশি ভাল হয় না ? চোখ বন্ধ করো...

এ আবার কেমন কথা চোখ বন্ধ করবো কি জন্য ?

ঠিক আছে না বন্ধ করলে দেখাবনা

আচ্ছা ঠিক আছে , এই যে চোখ বন্ধ করলাম...

মানুষটা আমার সামনে থেকে উঠে যেয়ে আবার ফেরত আসলো মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এসে লাগলো খুব চেনা চেনা কিন্তু মনে পরছেনা

হুম্ম... এবার চোখ খুলো

চোখ  খুলে আমি থ...

কি পছন্দ হয়েছে ?

মানুষটার হাতে খুব সুন্দর একটা ঝুড়ি আর ঝুড়িটা ভরতি দোলনচাঁপা...ওখান থেকেই মাতাল করা গন্ধটা আসছে আমি খুশি চেপে রাখতে পারছিনা এতো অবাক হয়েছি যে কি বলবো

আপনি জানলেন কি করে যে দোলনচাঁপা আমার খুব প্রিয় ?

জেনেছি... ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় ম্যাডাম আর আপনার জন্য এই ফুল খুঁজে আনতেই এতো দেড়ি হয়ে গেলো এবার বলুন , খুশি হয়েছেনতো ?

আমি কি বলবো কোন ভাষাই খুঁজে পাচ্ছিনা এই মুহূর্তে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে আমার জন্য মানুষটা এতো কষ্ট করে দোলনচাঁপা নিয়ে এসেছে , খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এলো...

কি হল , কাঁদছ কেন ? বাড়ির কথা মনে পরছে ? আরে কি হল , না বললে বুজবো কি করে ?

আমি কাছে এসে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলাম ওর বুকে মাথা রেখে বললাম , এমন করে সারাজীবন ভালবাসবেতো আমায় ?

গভীর আবেগে মানুষটা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল... সারাজীবন...

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন