দোলনচাঁপা
মেয়েদের বাড়ির প্রতি টান বেশি থাকে কারন তারা
জানে যে চাইলেও চিরদিন বাড়িতে থাকতে পারবে না । এক সময় না এক সময় পরের ঘরে যেতেই হবে । ছেলেদের যেহেতু পরের
ঘরে যাওয়া জাতীয় কোন ভয় থাকেনা তাই তাদের স্বাভাবিক ভাবেই ঘরের প্রতি টানটা কম থাকে
। এখানে অবশ্য কারো কোন
দোষ নেই , সৃষ্টি কর্তা উভয়কেই সৃষ্টি করে দিয়েছেন এমন
করে । এটা প্রকৃতির নিয়ম
।
সেই নিয়মের অংশ হিসেবেই এখন আমার বুক ফেটে
কান্না আসছে কারন কিছুক্ষণ আগেই আমি আমার নিজের বাড়ি ছেড়ে এসেছি । আজকে থেকে আমাকে থাকতে
হবে অচেনা একটা পরিবেশে । অচেনা কারন আমি আজই প্রথম এই বাড়িতে এলাম । মানুষগুলো আমার আপনজন
কিন্তু এখনও আমি কাউকে ঠিক মতো চিনিনা । চেনার সুযোগটাই পাইনি । কেমন করে জানি সব কিছু খুব দ্রুত হয়ে গেলো
।
একের পর এক লোকজন আসছে আমাকে দেখতে । ছবির জন্য পোজ দিতে
দিতে আমি কাহিল হয়ে গেছি । নিজেকে চিড়িয়াখানার কোন প্রাণী মনে হচ্ছে । মানুষজন খুব আগ্রহ
নিয়ে দেখছে আমাকে , নানান প্রশ্ন করছে । তবে সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারটা আমাকে বিব্রত
করছে সেটা হল বেশীর ভাগ লোকের কথাই আমি বুজতে পারছিনা। কারন ওরা কথা বলছে একটা আঞ্চলিক ভাষায় । এই ভাষাটা এখনও আমি
ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারিনি । মনে হয় কিছুটা সময় লাগবে আমার কারণ আমি ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত
শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে অভ্যস্ত । আমার আশে পাশেও তাই । এই কারনেই এখন আমার মনে হচ্ছে যেন মঙ্গল গ্রহে চলে এসেছি তবে
শান্তি লাগছে এই দেখে যে মানুষটা আমাকে যথাসম্ভব আগলে রাখার চেষ্টা করছে । বেশির ভাগ কথার জবাব
মানুষটাই দিচ্ছে । কেউ কেউ এটা নিয়ে ঠাট্টাও করছে যে এখনই এত বউ পাগল পরে কি হবে ।
পরে কি হবে আমি নিজেও জানি না । আমাদের বিয়েটা একদমই
পারিবারিকভাবে হয়েছে । আমরা দুজন দুজনকে তেমন একটা জানার সুযোগই পাই নি । তবে এ বাড়িতে আসার পর থেকে ও আমাকে এক মুহূর্তের
জন্যও ছেড়ে যায়নি , আশেপাশেই আছে । ওই মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুটা ভরসা পাচ্ছি
। তবে এই মুহূর্তে বাড়ির
কথা খুব মনে পরছে । বাড়ির বাইরে থেকেছি আমি খুব কমই । এক দিন থাকতেই আমার অস্থির লাগতো এখনত এটা ভেবে আরও বেশি অস্থির
লাগছে যে এখন থেকে এখানেই থাকতে হবে । কান্না আসছে খুব কিন্তু কাঁদতে পারছিনা ।
প্রথম যে দিন আমি বাসার বাইরে থেকেছিলাম সেটা
হচ্ছে আমার ভার্সিটির হল লাইফ এর প্রথম রাত
। বাসার জন্য এত মন খারাপ
লাগছিল যে সারাটা রাত বারান্দায় দাড়িয়ে কেঁদেছি । পরদিন সকাল হতেই বাড়ি চলে গেছি । এ নিয়ে বন্ধুরা এখনও
অনেক হাসাহাসি করে । হাসাহাসি করলেই বা আমার কি যায় আসে , আমি থাকতে পারিনা
তো এখন কি করব ? ৬ মাস অনেক কষ্টে থাকার পর আমি আবার বাসায়
চলে গিয়েছিলাম একদম সব কিছু নিয়ে । এর পর থেকে প্রতিদিন অনেকটা পথ বাস জার্নি করে ক্লাস করতাম । কিন্তু এখন কি করবো
? এখনত চাইলেও আর যেতে পারবনা । সারাজীবনের জন্য বাঁধা পরে গেলাম...
ভাবী , চলো ...
ভাবতে ভাবতে একদম নিজের মাঝে ডুবে গিয়েছিলাম
। মেয়েটা যে আমাকেই ডাকছে
বুজতে পারছিলামনা । না বুঝার অবশ্য আরও একটা কারন আছে । এখন পর্যন্ত অনেক ডাক ই শুনেছি কিন্তু ভাবী ডাকটা এই বাড়িতে
আসার পর থেকে শুনছি তাই এখনও ঠিক অভ্যস্ত হতে পারিনি ।
কই... এসো...
আমি উঠে দাঁড়ালাম । মনে হল যেন অনন্তকাল ধরে বসে ছিলাম । পা এ ঝি ঝি ধরে গেছে
। আস্তে আস্তে হাঁটতে
লাগলাম । কোথায় যাচ্ছি বুজতে পারছিনা । মানুষটাকেও আশেপাশে কোথাও দেখছিনা । অনেক বাঁধাবিপত্তি পেড়িয়ে দোতলায় এলাম । বাড়িটা বেশ সুন্দর
। পছন্দ হয়েছে আমার । যে ঘরটায়টায় আমরা এলাম
খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো । শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেলো...
এটা তোমার ঘর , পছন্দ হয়েছে ?
আমি তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম । এর মানে পছন্দ হয়েছে
।
এখানে সব কিছু দেয়া আছে , তুমি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও । সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমার উপর দিয়ে । আর কেউ বিরক্ত করবে
না । আমি ভাইয়া কে পাঠিয়ে
দিচ্ছি ।
শেস কথাটা বলার সময় দেখলাম ওর চোখে দুষ্টমি
খেলা করছে ।
আমি ঘরটা ভাল করে দেখতে লাগলাম । জানালার পাশে গেলাম
। বন্ধ ছিল কারন ঘরে
এসি চলছে । জানালাটা খুলতেই একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে গাঁয়ে লাগলো । মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই
বৃষ্টি হয়েছে । ইসশ... খুব ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে । মানুষটা যদি থাকতো বলে দেখা যেত । কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেলো এখনও দেখা নেই ।
ঠাণ্ডা পানির নিচে দাড়িয়ে সারাদিনের ক্লান্তি
দূর হয়ে গেল । অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিলাম । গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরে এলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় ২ টা বাজতে চললো
, এখনও এলো না ? ঘুম আসছে আমার
খুব কিন্তু মানুষটা কে রেখে ঘুমিয়ে পরবো ? মন সায় দিচ্ছেনা
। একটা বই নিয়ে সোফায়
যেয়ে আধ-শোয়া হয়ে বসলাম ।
মনে হল অনন্ত কাল পর সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ
পাওয়া যাচ্ছে । কেন জানি হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে বসলো আমাকে । আমি উঠে বসলাম সাথে সাথেই দরজা খুলে গেলো । আমি কেঁপে উঠলাম ,
ব্যাপারটা মানুষটার চোখ এরায়নি ।
আরে আরে , তুমি এমন কাঁপছ কেন । রিল্যাক্স এন্ড সরি , দেরি হয়ে গেল । তোমাকে অনেক্ষন একা থাকতে হল ।
আমি স্বাভাবিক ভাবে হাসার চেষ্টা করলাম । না , ঠিক আছে , কোন সমস্যা হয়নি। বইটা পড়তে পড়তেই সময়
কেটে গেছে ।
আসলে তোমার কারনেই একটু দেড়ি হয়ে গেলো ।
আমার কারনে ? বলে কি এই ছেলে , আমি আবার কি করলাম ?
আমার
কারনে দেড়ি হল , আসলে ব্যাপারটা ঠিক বুজলাম না । একটু বুঝিয়ে বলুনতো
।
বলার চেয়ে দেখালেই বেশি ভাল হয় না ?
চোখ বন্ধ করো...
এ আবার কেমন কথা । চোখ বন্ধ করবো কি জন্য ?
ঠিক আছে না বন্ধ করলে দেখাবনা ।
আচ্ছা ঠিক আছে , এই যে চোখ বন্ধ করলাম...
মানুষটা আমার সামনে থেকে উঠে যেয়ে আবার ফেরত
আসলো । মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে
এসে লাগলো । খুব চেনা চেনা কিন্তু মনে পরছেনা ।
হুম্ম... এবার চোখ খুলো ।
চোখ
খুলে আমি থ...
কি পছন্দ হয়েছে ?
মানুষটার হাতে খুব সুন্দর একটা ঝুড়ি আর ঝুড়িটা
ভরতি দোলনচাঁপা...ওখান থেকেই মাতাল করা গন্ধটা আসছে । আমি খুশি চেপে রাখতে পারছিনা । এতো অবাক হয়েছি যে
কি বলবো ।
আপনি জানলেন কি করে যে দোলনচাঁপা আমার খুব
প্রিয় ?
জেনেছি... ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় ম্যাডাম । আর আপনার জন্য এই ফুল
খুঁজে আনতেই এতো দেড়ি হয়ে গেলো । এবার বলুন , খুশি হয়েছেনতো ?
আমি কি বলবো কোন ভাষাই খুঁজে পাচ্ছিনা । এই মুহূর্তে নিজেকে
সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে । আমার জন্য মানুষটা এতো কষ্ট করে দোলনচাঁপা নিয়ে এসেছে ,
খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এলো...
কি হল , কাঁদছ কেন ? বাড়ির কথা মনে পরছে ? আরে কি হল , না বললে বুজবো কি করে
?
আমি কাছে এসে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলাম । ওর বুকে মাথা রেখে
বললাম , এমন করে সারাজীবন ভালবাসবেতো আমায় ?
গভীর আবেগে মানুষটা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল...
সারাজীবন...।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন